ইসলামে দারিদ্র্য বিমোচনের পথ ও পদ্ধতি
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দারিদ্র্য একটি সামাজিক ও মানবিক সমস্যা। সম্ভবত পৃথিবীতে মানবসভ্যতা যতটা প্রাচীন, দারিদ্র্য সমস্যাটিও ততই পুরোনো। বর্তমান বিশ্বে রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও মানবসেবায় নিয়োজিত অসংখ্য ব্যক্তি ও সেবা-সংগঠন বিশ্বমানবতাকে দারিদ্র্যমুক্ত করার লক্ষ্যে প্রাণান্তকর প্রয়াস চালিয়ে আসছে। বিশেষত জাতিসংঘ দারিদ্র্যকে অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। অথচ বাস্তবে দারিদ্র্য নিরসন সম্ভব হচ্ছে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এক সময় মুসলিম খলিফা ও শাসকরা তাদের প্রতিষ্ঠিত সমাজ ও রাষ্ট্রকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
কুরআন ও হাদিসে বিশেষত, জাকাত বণ্টনের খাত আলোচনায় দরিদ্র ব্যক্তিকে ‘ফকির’ ও ‘মিসকিন’-এ দুটি স্তরে বিন্যস্ত করা হয়েছে। একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসাবে ইসলাম দারিদ্র্য বিমোচনে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণে এটা প্রমাণিত, ইসলামি বিধানের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন পরিপূর্ণ দারিদ্র্য দূরীকরণে সম্পূর্ণ সফল হয়েছে। সুতরাং আমাদের দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলামের সুমহান আদর্শ উৎসারিত কর্মকৌশল প্রণয়ন করতে হবে। এ কর্মকৌশলের নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ-
শ্রমের মাধ্যমে : ইসলামের দাবি হচ্ছে সমাজের প্রতিটি সক্ষম মানুষ কাজ করবে এবং অলস জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে না। তাই রিজিকের অন্বেষণে ইসলাম প্রত্যেককে পৃথিবী চষে বেড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে। কুরআন মাজিদে ঘোষিত হয়েছে-‘তিনিই তো তোমাদের জন্য ভূমিকে সুগম করে দিয়েছেন। অতএব, তোমরা এর দিগ-দিগন্তে বিচরণ কর এবং তার প্রদত্ত জীবনোপকরণ থেকে আহার্য গ্রহণ কর’। (সূরা মুলক : ১৫।) উপরোক্ত আয়াত থেকে যে বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় তা হচ্ছে, শ্রমই দারিদ্র্য বিমোচনের একমাত্র হাতিয়ার এবং সম্পদ উপার্জনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম।
দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে : দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য মানুষ শ্রমকে বেছে নেবে-ইসলামে এটাই প্রত্যাশিত। যারা কাজ করতে অক্ষম, যেমন-চিররোগী, সাময়িক রোগী, প্রতিবন্ধী, নিরুপায়, দুস্থ, বেকার তাদের কথা স্বতন্ত্র। ইসলাম তাদের দারিদ্র্যের তীব্র কশাঘাত থেকে রক্ষার ব্যবস্থা করেছে। আর তা হচ্ছে, অসচ্ছলের পাশে সচ্ছল আত্মীয়স্বজন দাঁড়াবে এবং সার্বিক সহযোগিতা করবে। কুরআন মাজিদে ঘোষিত হয়েছে-‘এবং আত্মীয়রা আল্লাহর বিধানে একে অন্যের চেয়ে অধিক হকদার’। (সূরা আনফাল : ৭৫।)
জাকাতের মাধ্যমে : জাকাত দারিদ্র্য বিমোচনের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। ইসলাম প্রত্যেক সক্ষম ব্যক্তিকে নিজের ও তার পরিবার-পরিজনকে অভাবমুক্ত রাখা এবং আল্লাহর পথে ব্যয়ের জন্য নির্দেশ দিয়েছে। জাকাতের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, দারিদ্র্য বিমোচন। ফকির ও মিসকিন হলো জাকাতের অর্থ ব্যয়ের প্রধান খাত। মহানবী (সা.) মুয়াজ (রা.)কে ইয়ামেনে প্রেরণকালে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা উল্লেখ করা যায়। তিনি তাকে বলেছিলেন-‘তুমি ধনীদের কাছ থেকে জাকাত আদায় করে দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করবে’। (বুখারি।)
উশরের মাধ্যমে : উশরের অর্থ এক-দশমাংশ। ইসলামি পরিভাষায় জমির ফসলের জাকাতকে উশর বলা হয়। আল্লাহ বলেন-‘হে মুমিনগণ! তোমরা যা উপার্জন কর এবং আমি ভূমি থেকে যা তোমাদের জন্য উৎপাদন করে দিই; তার মধ্যে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় কর এবং ব্যয় করতে গিয়ে খারাপ জিনিস দিতে ইচ্ছা কর না’। (সূরা বাকারা : ২৬৭।) এ ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘বৃষ্টির মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলের দশ ভাগের এক ভাগ (জাকাত) দিতে হবে এবং কৃত্রিম সেচের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ দিতে হবে’। (আবু দাউদ।)
কাফফারার মাধ্যমে : কোনো পাপ কাজ সংঘটিত হয়ে গেলে তা মোচনের জন্য যে কাজ সম্পাদন করতে হয় তাকে কাফফারা বলে। যেমন-শপথ ভঙ্গ করলে কাফফারা আদায় করতে হয়। কাফফারা আর্থিকভাবে আদায় করলে তা দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক হতে পারে।
ফিদিয়ার মাধ্যমে : যেসব লোক বার্ধক্যজনিত কারণে কিংবা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়েছে, এহেন অবস্থায় তার রোজা না রেখে ফিদিয়া আদায়ের সুযোগ রয়েছে। কুরআন মাজিদে উল্লেখ আছে-‘রোজা যাদের অতিশয় কষ্ট দেয় তাদের কর্তব্য এর পরিবর্তে ফিদিয়া-একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান করা’। (সূরা বাকারা : ১৮৪।) ফিদিয়ার মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ দারিদ্র্য বিমোচনের কাজে ব্যয় হতে পারে। এ ফিদিয়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে ব্যয় হতে পারে।
দেনমোহরের মাধ্যমে : দেনমোহর এমন সম্পদ, যা বিবাহের সময় স্বামী তার স্ত্রীকে প্রদান করে থাকে। ইসলামি আইনে এ সম্পদ স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে প্রদান করা ফরজ। দেনমোহর স্ত্রী জাতির অর্থনৈতিক অধিকার। কুরআন মাজিদে উল্লেখ আছে, ‘তোমরা নারীদের তাদের দেনমোহর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রদান করবে’। (সূরা নিসা : ৪।)
উল্লেখ্য, দেনমোহরের অর্থ ধনী ও দরিদ্র নির্বিশেষে সব শ্রেণির নারীর আর্থিক নিরাপত্তা ও দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ধরনের অবদান রাখতে পারে।
সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের মাধ্যমে : রমজানের রোজা পালন করার পর ঈদুল ফিতরের দিন প্রত্যেক বিত্তবানকে তার নিজের, পরিবার-পরিজনের ও পোষ্যদের কাছ থেকে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হয়। সাদাকাতুল ফিতরের ব্যক্তিগত দান হলেও মহানবী (সা.) তা আদায় করে দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন। কাজেই সাদাকাতুল ফিতর দারিদ্র্য বিমোচনে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে।
হেবার মাধ্যমে : হেবা দানের অন্যতম একটি প্রকরণ। হেবা দারিদ্র্য বিমোচনের উদ্দেশ্যে একটি ভালো উপায়। শরিয়তে হেবা একটি অনুমোদিত বিষয়।
ওয়াকফ করার মাধ্যমে : ওয়াক্ফ বলতে কোনো মুসলিম ব্যক্তি বৈধ উপায়ে উপার্জিত স্থাবর কিংবা অস্থাবর সম্পদ থেকে মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের জন্য স্বত্ব ত্যাগপূর্বক দান করাকে বোঝায়। এ সম্পদ দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অবদান রাখতে পারে।
ওসিয়তের মাধ্যমে : মৃত্যুর পর সমাজকল্যাণমূলক কাজে বা দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে স্বীয় সম্পদের একাংশ দান করার ঘোষণা দেওয়ার নাম ওসিয়ত। এ ওসিয়ত সর্বোচ্চ এক-তৃতীয়াংশ করা যাবে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘এক-তৃতীয়াংশ ওসিয়ত কর। কেননা এক-তৃতীয়াংশ অনেক বেশি অথবা বড়’। (বুখারি।)
করজে হাসানার মাধ্যমে : যে ঋণ বিনা সুদে নিঃস্বার্থভাবে মানুষের কল্যাণের নিমিত্তে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে প্রদান করা হয়, তাকে করজে হাসানা বলা হয়। এর মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের আর্থিক অসচ্ছলতা দূরীকরণে সহায়তা করা যায়।
প্রতিবেশীর অধিকার আদায়ের মাধ্যমে : প্রতিবেশীর অধিকার আদায় করার বিষয়টি কুরআন ও হাদিসে বিশেষ তাগিদসহকারে স্থান পেয়েছে। মহানবী (সা.) প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে বলেন, ‘সে ব্যক্তি মুমিন নয়, যে তৃপ্তিসহকারে আহার করে আর তার পাশেই তার প্রতিবেশী অভুক্ত থাকে। (মিশকাত।)
আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে : ইসলাম পরনির্ভরশীলতাকে নিরুৎসাহিত করে, পক্ষান্তরে স্বনির্ভরতাকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করে। কাজেই আয় বৃদ্ধি করার কাজ কষ্টসাধ্য হলেও ইসলাম তারই নির্দেশ দেয়। কুরআন মাজিদে আছে-‘নামাজ শেষ হলে তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (রিজিক) সন্ধান কর’। (সূরা জুমা : ১০।) মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘অন্যান্য ফরজের পর হালাল উপার্জন অন্যতম ফরজ’। (মিশকাত।)
উপার্জনের সুযোগ অবারিত রাখার মাধ্যমে : দারিদ্র্য সমাজ সভ্যতাকে এগিয়ে নেওয়ার পরিবর্তে পিছিয়ে দেয়। জীবিকা উপার্জনের সুযোগ অবারিত না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে মানুষ দারিদ্র্য অবস্থায় নিপতিত হয়। এ জন্য ইসলাম জীবিকা উপার্জনের লক্ষ্যে সুযোগ উন্মুক্ত রাখার পক্ষে। কেননা কুরআন মাজিদে আছে-‘যেন তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান কেবল তাদের মধ্যেই ঐশ্বর্য আবর্তন না করে’। (সূরা হাশর ৫৯ : ৭।)
সুষম বণ্টনের মাধ্যমে : কোনো দেশে জনপ্রতি বার্ষিক আয় বিপুল হলেও সে দেশে অসম বণ্টন হওয়ার কারণে দারিদ্র্য বিরাজ করতে পারে। তাই বণ্টনের ক্ষেত্রে সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অন্যথায় অন্যের ওপর অবিচার করা হবে।
ব্যবসায়-বাণিজ্যের মাধ্যমে : ইসলাম ব্যবসায়-বাণিজ্যের ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে। মহানবী (সা.) এবং তার বিপুল সাহাবি ব্যবসায়-বাণিজ্য করতেন। তিনি বলেন, ‘সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীরা নবী-সিদ্দিকগণ ও শহীদগণের সঙ্গে (কিয়ামতের দিন) থাকবেন’। (তিরমিজি।) মোটকথা ব্যবসা-বাণিজ্য করার মাধ্যমে মানুষ দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ অবদান রাখতে পারে।
