তুমি না এলে দুনিয়ায় আঁধারে ডুবিত সবি
মাহমুদ আহমদ
প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আলহামদুলিল্লাহ, পবিত্র রবিউল আউয়াল মাস চলছে। সর্বকালের ও সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ মানুষ এবং নবীকুল শিরোমণি হজরত মুহাম্মাদ (সা)-এর আগমনে ধন্য ত্রিভুবন। সারা জাহান যখন জুলুম, অত্যাচার ও নির্যাতনের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত ঠিক তখন মানবতার মুক্তি ও ত্রাণকর্তা হিসাবে পবিত্র এ রবিউল আউয়াল মাসে তার আগমন। বিশ্বনবীর সমগ্র জীবন অতিবাহিত হয়েছে মানুষের মুক্তি, সাধন, ঐক্য ও সুসভ্য জাতি হিসাবে গড়ে তোলার জন্য। এ জন্যই আল্লাহতায়ালা তাকে সম্বোধন করে বলেছেন ‘রহমাতাল্লিল আলামিন’ অর্থাৎ সারা বিশ্বের রহমত স্বরূপ। জনদরদি এ মহানবী (সা.) মানুষকে সব ধরনের পঙ্কিলতা, অনিয়ম, অনাচার, পাপাচার ও অন্ধকারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করতে আজীবন চেষ্টা চালিয়েছেন, সংগ্রাম করেছেন। তার সংগ্রাম ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠার, তিনি রাজ্য দখলের জন্য সংগ্রাম করেননি। সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠার অভীষ্ট লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত তিনি ক্ষান্ত হননি। নিজে বহু কষ্ট করেছেন, নানা বাধা-বিঘ্নের সম্মুখীন হয়েছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন, লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়েছেন, জীবনের ওপরে বারবার হুমকি এসেছে, তবুও তিনি পিছিয়ে যাননি। একাধারে বিরামহীন চেষ্টা ও অক্লান্ত পরিশ্রম দিয়ে তিনি জয়যুক্ত হয়েছেন। এভাবে সেকালের ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
মহানবী (সা.)-এর মাধ্যমে বিশ্বের জাতিগুলো আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অনুগ্রহপ্রাপ্ত হয়েছে। কারণ আগে কখনো মানব জাতির ওপর আল্লাহতায়ালার রহমত এরূপ ব্যাপক আকারে বর্ষিত হয়নি। তিনি (সা.) নিজেও একই বক্তব্য বিভিন্ন হাদিসে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন। যেমন-মহানবী (সা.) বলেছেন ‘আমাকে সাদা-কালো নির্বিশেষে সবার জন্য পাঠানো হয়েছে’। (মুসনাদে আহমদ।)
মহানবী (সা.)-এর আগে আবির্ভূত আল্লাহতায়ালার সব নবী জাতীয় নবী ছিলেন। তাদের শিক্ষা যে জাতির কাছে তারা প্রেরিত হয়েছিলেন, সে জাতির উদ্দেশ্যে ছিল এবং সেই বিশেষ কালের জন্য প্রযোজ্য ছিল, যে সময় তাদের আবির্ভাব হয়েছিল। পক্ষান্তরে বিশ্বনবী (সা.) প্রেরিত হয়েছিলেন সমগ্র মানব জাতির হেদায়াত ও কল্যাণের জন্য। মানব ইতিহাসে তার আবির্ভাব এক অনুপম ঘটনা। যার উদ্দেশ্য ছিল সব পৃথক পৃথক জাতি ও বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীকে একই ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ করা, যেখানে জাতি, ধর্ম ও বর্ণ সব ভেদাভেদ বিলীন হয়ে যাবে। যেভাবে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ রয়েছে-‘আমি তোমাকে বিশ্বজগতের জন্য শুধু এক রহমত রূপেই পাঠিয়েছি’। (সূরা আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭।) তাই তো উম্মতে মুহাম্মাদিকে সব সময় দরুদ পাঠের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেভাবে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করছেন ‘নিশ্চয় আল্লাহ ও তার ফেরেশতারা এ নবীর প্রতি রহমত বর্ষণ করছেন। হে যারা ইমান এনেছ! তোমরাও তার প্রতি দরুদ পাঠ কর এবং তার জন্য বেশি বেশি করে শান্তি কামনা কর। নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তার রাসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের প্রতি ইহকালে ও পরকালে অভিসম্পাত করেছেন এবং তিনি তাদের জন্য লাঞ্ছনাদায়ক আজাব প্রস্তুত করে রেখেছেন।’ (সূরা আল আহযাব : ৫৫-৫৬।)
মহানবী (সা.) সব ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য যেভাবে শান্তি কামনা করেছেন, তেমনি তিনি সর্বস্তরে সেই শান্তি প্রতিষ্ঠাও করেছেন। ইসলাম এমন একটি সত্য ধর্ম, যার প্রমাণ দেওয়ার যেমন কোনো প্রয়োজন নেই, ঠিক তেমনই বিশ্বনবী (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়েও কারও সন্দেহ থাকার কোনো অবকাশ নেই। তাই তো এ সত্য ধর্ম ইসলাম এবং সত্য ও শ্রেষ্ঠ নবীর অবমাননা করাও কারও পক্ষে সম্ভব নয়। যারা এমনটি করার সাহস দেখাবে তারা নিজেরাই ধ্বংস হয়ে যাবে।
মহানবী (সা.)-এর আদর্শ কতই না অনুপম ছিল যে, তিনি (সা.) বলেছেন, ‘একজন মুসলমান হলো সেই ব্যক্তি, যার হাত এবং জিহ্বা থেকে অন্যেরা নিরাপদ থাকে’। (বুখারি-মুসলিম।) বস্তুত ইসলামি শিক্ষা এক মুসলমানকে শান্তি প্রিয়, বিনয়ী এবং মহৎ গুণাবলির অধিকারী হতে উদ্বুদ্ধ করে। এ শিক্ষা ভুলে পরস্পর হানাহানির নীতি কোনো ক্রমেই ইসলাম সমর্থন করে না। যদিও এ কথা অনেকেই বাস্তব ক্ষেত্রে বেমালুম ভুলে বসেছে। যদি আমার হাত ও মুখ থেকে অন্যরা নিরাপদই না থাকে তাহলে আমার কাজ প্রমাণ করে যে, আমি শান্তির ধর্ম ইসলাম এবং উম্মতে মুহাম্মাদির অনুসারী নই।
বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর শিক্ষা দেখুন, একবার এক জিহাদের ময়দানে উসামা বিন যায়েদ (রা.)-এর সঙ্গে এক ব্যক্তির লড়াই হচ্ছিল। উসামা বিন যায়েদ লোকটিকে যুদ্ধে পরাস্ত করেন এবং হত্যা করতে উদ্যত হন। এমন সময় অবিশ্বাসী লোকটি সম্পূর্ণ কালেমা নয় বরং এর প্রথমাংশ পাঠ করে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয়। তথাপি উসামা তাকে হত্যা করেন। ঘটনাটি হজরত রাসূলে কারিম (সা.)-এর কাছে পৌঁছলে উসামাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, সে ইসলাম গ্রহণ করার পরও তুমি তাকে কেন হত্যা করলে? উত্তরে উসামা বলেছিলেন, ইয়া রাসূল! সে তো প্রাণের ভয়ে ইসলাম কবুল করেছিল?
মহানবী (সা.) তখন বলেছিলেন ‘তুমি কি তার হৃদয় ফেড়ে দেখেছিলে যে, সে সত্য সত্যই ইসলাম গ্রহণ করেছিল, না প্রাণের ভয়ে এ কথা উচ্চারণ করেছিল? মহানবী (সা.) অতঃপর বলতে লাগলেন, কাল হাশরের ময়দানে আল্লাহর সামনে তুমি কি করে তোমার কাজকে সঠিক সাব্যস্ত করবে? তিনি (সা.) বলেন, যখন কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে তখন তুমি কী করবে? মহানবী (সা.)-এর এরূপ ভয়ানক অসন্তুষ্টি দেখে উসামা ঘাবড়ে যান আর তিনি (সা.) তখনো ওই কথাই বারবার বলছিলেন যে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ যখন তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে, তখন তুমি কী করবে? উসামা পরে বলেছিলেন, ‘হায়! আমি যদি এ ঘটনার পর ইসলাম গ্রহণ করতাম’। এ ঘটনা এবং আরও নানা ঘটনা থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, বলপূর্বক মুসলমান বানানো ইসলামি ‘জিহাদে’র উদ্দেশ্য কখনোই ছিল না এবং সে যুগে বলপূর্বক কাউকে মুসলমান করাও হয়নি, কোনো যুদ্ধ বন্দিকেও না। ইসলাম কখনো তরবারির দ্বারা প্রসার লাভ করেনি, ইসলাম প্রসার লাভ করেছে বিশ্বনবী (সা.)-এর উন্নত আদর্শ, মানবপ্রেম, তাবলিগ ও ক্ষমার দৃষ্টান্তের মাধ্যমে।
আল্লাহতায়ালা মহানবী (সা.)-এর মাধ্যমে ন্যায়ের তুলাদণ্ডে তুলে ধরেন এবং ইনসাফ ও রহমতের শাসন কায়েম করেন, যার ফলে তিনি (সা.) ঘোষণা করলেন-কারও ওপরে আর জুলুম হবে না। ধর্মের ব্যাপারে কারও হস্তক্ষেপ থাকবে না, জবরদস্তি থাকবে না। নারী ও ক্রীতদাসের প্রতি যে জুলুম করা হচ্ছে, তা শেষ করা হবে এবং শয়তানের হুকুমতের জায়গায় এক আল্লাহর হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হবে। ঠিক এমনই হলো, জুলুম অত্যাচারের রাজত্বের পর দলে দলে লোক মহানবী (সা.)-এর আদর্শ দেখে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলেন। মুসলমানদের একের পর এক বিজয় হতে লাগল। মদিনার পৌত্তলিকরাও ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলেন। ধীরে ধীরে মুসলমানদের অন্ধকার রজনি কেটে গেল, উদিত হলো নতুন সূর্য, মক্কা মুসলমানদের অধীনে চলে এলো। অল্প দিনের মধ্যেই সারা আরবে ইসলামি পতাকা পত পত করে উড়তে থাকল। এত অল্প সময়ে ইসলামের বিজয়ের পেছনে কোন শক্তি কাজ করেছিল? এর পেছনে বিশ্বনবী (সা.)-এর মানবপ্রেম ও দোয়ার বরকতেই ইসলামের বিজয় ও অন্ধকার যুগকে আলোকিত করেছিল। তাই আমরাও যদি মানবপ্রেমী হই তাহলেই সমাজ থেকে সব অশান্তি দূর করা সম্ভব হবে। আল্লাহতায়ালা আমাদের শ্রেষ্ঠ নবী (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করে চলার তৌফিক দিন, আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
masumon83@yahoo.com
