এখন জরুরি ডেঙ্গুর উপযুক্ত টিকা
ড. মো. গোলাম ছারোয়ার
প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ডেঙ্গুজ্বর মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায় এবং মশা নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য হলেও টিকাদান অতিরিক্ত সুরক্ষা প্রদান করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডেঙ্গুকে বিশ্বব্যাপী শীর্ষ ১০টি স্বাস্থ্য হুমকির মধ্যে একটি হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে; ২০০০ সালে ৫ লাখ থেকে দশগুণ বেড়ে ২০১৯ সালে ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। ২০২৩ সালে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে, যা অভূতপূর্ব। প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ৬৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে এবং ৬ হাজার ৮শ জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। আফ্রিকা, আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ৮০টিরও বেশি দেশে এ রোগে আক্রান্তের ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে। ২০২৩ সালে এশিয়ায় সর্বোচ্চ মৃত্যুর হারও রেকর্ড করা হয়েছে। সেই বছর বাংলাদেশে দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, যেখানে আক্রান্তের ৩,২১,১৭৯টি নিশ্চিত কেসের মধ্যে ১,৭০৫ জন মারা গেছে। এর কেস ফ্যাটালিটি রেট বা সিএফআর ভয়ংকর, ০.৫৩ শতাংশ।
এছাড়া ২০২২ সালে ডেঙ্গুর ধরনে স্থায়ী ও সাময়িক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়, যা ২০২৩ সালেও অব্যাহত থাকে। নেপাল ও বাংলাদেশে স্বাভাবিকের তুলনায় আক্রান্তের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়ে যায়। ২০২২ সালে ডেঙ্গু নেপালের কাঠমান্ডু উপত্যকা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব তরাই অঞ্চল এবং ২০২৩ সালে গন্ডাকি প্রদেশের পার্বত্য জেলায় স্থানান্তরিত হয়। ২০২৩ সালে ভারত, কেরালা এবং বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোয় আক্রান্তের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেতেও দেখা গেছে। ১৯৮০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ভিয়েতনামে প্রায় প্রতি ১০ বছরে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা সর্বোচ্চ দেখা গেছে। ২০২২ সালে ভিয়েতনামে ৩ লাখ ৬৭ হাজারেরও বেশি ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তের খবর পাওয়া যায়, যা বিশ্বে ব্রাজিলের পরেই দ্বিতীয়।
যে কেউ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হতে পারে; তবে শিশু, গর্ভবতী নারী এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ থাকা কিংবা স্থূলকায় ব্যক্তিদেরই আক্রান্তের ঝুঁকি বেশি। চিকিৎসা না করা হলে ডেঙ্গু হাইপোটেনশন, হার্ট ফেইলিওর, কিডনি ফেইলিওর, হেমোরেজিক শক, মাল্টিপল অর্গান ফেইলিওর, সেরিব্রাল হেমোরেজ, কোমাসহ গুরুতর জটিলতা দেখা দিতে পারে। বর্তমান চিকিৎসায় রক্ত-পরিস্রাবণ, প্লাজমা বিনিময় এবং শকবিরোধী ব্যবস্থার মাধ্যমে লক্ষণগুলো পরিচালনার ওপর দৃষ্টিনিবদ্ধ করে। গুরুতর রোগীর চিকিৎসার খরচ অধিকাংশ মানুষের অর্থনৈতিক সামর্থ্যরে চেয়ে বেশি হতে পারে।
অনুমোদিত ডেঙ্গু ভ্যাকসিনগুলো হলো কিউডেঙ্গা ও ডেংভ্যাক্সিয়া, যার কার্যকারিতা এবং সুপারিশকৃত জনসংখ্যা বিভিন্ন। লক্ষণীয় ডেঙ্গু প্রতিরোধে Dengvaxia -এর কার্যকারিতা প্রায় ৬০-৮০ শতাংশ, তবে এটি ৯-১৬ বছর বয়সি শিশুদের জন্য সীমাবদ্ধ, যাদের আগে নিশ্চিত ডেঙ্গু সংক্রমণ ছিল। কারণ সেরোনেগেটিভ ব্যক্তিদের মধ্যে গুরুতর রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। অন্যদিকে, কিউডেঙ্গা উচ্চতর সামগ্রিক কার্যকারিতা প্রদর্শন করে। ৪ বছর বা তার বেশি বয়সি সেরোপজিটিভ এবং সেরোনেগেটিভ, উভয় ধরনের ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে লক্ষণগত ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে প্রায় ৮০ শতাংশ সুরক্ষা প্রদান করে।
কিউডেঙ্গা উদ্ভাবন করেছিল জাপানি কোম্পানি তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যালস, যারা চারটি ডেঙ্গু ভাইরাসের সেরোটাইপ থেকে রক্ষা করার জন্য লাইভ, অ্যাটেনুয়েটেড ডেঙ্গু ভ্যাকসিন (টিএকে-০০৩) তৈরি করেছিল। কিউডেঙ্গা অনুমোদনকারী নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে: ২০২২ সালে ইউরোপীয় মেডিসিন এজেন্সি (ইএমএ) এবং ইউরোপীয় কমিশন (ইসি), এরপরে ইন্দোনেশিয়া, গ্রেট ব্রিটেন, ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার মতো অন্যান্য দেশও অন্তর্ভুক্ত হয়।
সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত, কিউডেঙ্গা ৪০টি দেশে এটি অনুমোদিত ছিল এবং ২৭টি দেশে উপলব্ধ হয়, যার মধ্যে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া (অনুমোদিত আগস্ট ২০২২, উপলব্ধ এপ্রিল ২০২৩), ব্রাজিল (অনুমোদিত মার্চ ২০২৩, উপলব্ধ জুন ২০২৩, থাইল্যান্ড (অনুমোদিত মে ২০২৩, উপলব্ধ আগস্ট ২০২৩), আর্জেন্টিনা (অনুমোদিত এপ্রিল ২০২৩, উপলব্ধ অক্টোবর ২০২৩), (অনুমোদিত ফেব্রুয়ারি ২০২৪) এবং ভিয়েতনামেও উপলব্ধ।
কিউডেঙ্গার কার্যকারিতা ও প্রভাব
কিউডেঙ্গা টিকা চার ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধেই সুরক্ষা প্রদানে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকারিতা প্রদর্শন করেছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এটি হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকি ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দেয়। এটি বাংলাদেশের মতো বিভিন্ন দেশে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অন্তত একবার ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। যার পরবর্তী সংক্রমণ আরও তীব্র হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, ফলে সময়মতো টিকাদান একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হয়ে ওঠে।
ভ্যাকসিনের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য তাকেদার সঙ্গে যোগাযোগ করা প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারকে সঙ্গে নিয়ে উদ্যোগ গ্রহণও অতি প্রয়োজন। যার মূল উদ্দেশ্য হবে কীভাবে ডেঙ্গুজ্বরের বার্ষিক বোঝা কমানোর প্রতিশ্রুতিকে জোরদার করা যায়। রক্ষা করা যায় শত শত অমূল্য প্রাণ।
আমাদের দেশের মানুষ নানা প্রয়োজনে ডেঙ্গুসংক্রামক অঞ্চলে ঘনঘন ভ্রমণ করে থাকেন। তারা কখন, কীভাবে টিকা ব্যবহার করবেন, তাও নিশ্চিত করতে হবে। তাদের চাহিদা ও জোগানের মধ্যেও সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে সুইডেনের একটি উদাহরণ তুলে ধরা হলো। সুইডিশ সোসাইটি ফর ইনফেকশাস ডিজিজেস ফিজিশিয়ানসের ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞ দলের ভ্রমণ ভ্যাকসিন হিসাবে কিউডেঙ্গা ব্যবহারের নির্দেশনা এবং সুপারিশগুলো নিম্নরূপ :
যেসব ভ্রমণকারীর আগে (হাসপাতালে ভর্তি বা পলিক্লিনিক পরীক্ষার মাধ্যমে জানা) ডেঙ্গুজ্বর হয়েছে, তাদের জন্য অন্য দেশে ভ্রমণের আগে টিকা দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ডেঙ্গুতে ভুগছেন, এমন ভ্রমণকারীদের ভ্রমণের সময়কাল নির্বিশেষে ৪-১৬ বছর বয়সি ব্যক্তিদের টিকা দেওয়ার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। ১৭-৬০ বছর বয়সি ভ্রমণকারীদের জন্য শুধু দীর্ঘ ভ্রমণ এবং ভ্রমণের গন্তব্যের সঙ্গে সম্পর্কিত টিকা দেওয়ার কথা বিবেচনা করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভ্রমণে ছয় সপ্তাহের বেশি সময় সীমাসমৃদ্ধ টিকা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ সেখানে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ। যেহেতু কিউডেঙ্গা এখনো ৬০ বছরের বেশি বয়সি ব্যক্তিদের ওপর পরীক্ষা করা হয়নি, তাই তারা স্পষ্টতই পরামর্শ দিচ্ছেন, রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত এ জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতার বাইরে রাখা উচিত।
ক্রমবর্ধমান ডেঙ্গুর ভয়াবহতা রোধে বাহকের নিয়ন্ত্রণ যেমন জরুরি, তেমনই জরুরি নিজেদের সুরক্ষায় ভ্যাকসিনের; যার মাধ্যমে ব্যক্তির প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, সুরক্ষিত হবে দেশ। নিরাপদে ভ্রমণ ও জীবনযাপনের জন্য টিকাদানের সঙ্গে সঙ্গে এডিস মশার বিস্তার রোধ করাও অপরিহার্য।
ড. মো. গোলাম ছারোয়ার : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)
