বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ৩৩ বছর
ধ্বংসের ওপর কোনো সভ্যতার ভিত্তি গড়ে ওঠে না
প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:৫৪ এএম
১৯৯২ সালে ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের ধ্বংস কোনো স্থাপনার পতন ছিল না; এটি ছিল বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, নাগরিকতা ও রাষ্ট্রনৈতিক স্থিতির ওপর প্রত্যক্ষ আঘাত।
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
৬ ডিসেম্বর—দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে এক এমন দিন, যার ছায়া সময়ের স্রোতে মিলিয়ে যায় না। ১৯৯২ সালে ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের ধ্বংস কোনো স্থাপনার পতন ছিল না; এটি ছিল বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, নাগরিকতা ও রাষ্ট্রনৈতিক স্থিতির ওপর প্রত্যক্ষ আঘাত।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক আকাশে যেন সেই মুহূর্তে একটি ছিন্নমূল সত্য উন্মুক্ত হয়ে পড়ে—যে আবেগ যখন রাষ্ট্রচিন্তার উপরে উঠে আসে, তখন ইতিহাস তার ধারাবাহিকতা হারায় এবং সমাজ হারায় তার নৈতিক মেরুদণ্ড।
১৫২৮ সালে মীর বাকীর নির্মিত বাবরি মসজিদ চার শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে মুসলিম উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ঔপনিবেশিক ইতিহাসকার স্মিথ, মিল, হাভেল—অনেকেই এই স্থাপত্যকে অযোধ্যার বহুত্ববাদী ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
১৮৫৩ সালে প্রথম সংঘাত সৃষ্টি হলে ব্রিটিশ প্রশাসন ১৮৫৯ সালে একটি প্রাচীর তুলে দেয়—যা ছিল সাম্প্রদায়িক বিভেদের প্রথম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। ১৯৪৯ সালের এক রাতে মসজিদে হঠাৎ মূর্তি স্থাপনের ঘটনা ভারতের প্রশাসনিক ইতিহাসে এক অন্ধকার রাত হিসেবে চিহ্নিত।
জেলার ম্যাজিস্ট্রেট সেই ঘটনাকে “অলৌকিক” বলার চাপের কাছে মাথানত করেননি, কিন্তু রাজনৈতিক শক্তির প্রভাবে মসজিদ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। সেই রাত যেন ভবিষ্যতের বিস্ফোরণের মাটি উর্বর করে দিয়েছিল।
আশির দশকে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান রামমন্দির আন্দোলনকে রাষ্ট্রীয় আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। ১৯৯০ সালে আডভানির রথযাত্রা ভারতীয় রাজনীতিকে ধর্মীয় পরিচয়ের উন্মাদনায় আন্দোলিত করে; রাষ্ট্রচিন্তা আবেগের তীব্র প্রবাহে প্রভাবিত হতে শুরু করে। আর তারই পরিণতি—১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের ভয়াবহ সকাল।
বিশাল সমাবেশের উদ্দেশ্য স্পষ্ট ছিল; সংগঠিত উসকানি, উত্তেজিত জনতার ঢল, প্রশাসনের অব্যবস্থা, এবং রাজনৈতিক কাঠামোর নীরবতা—সবকিছু মিলিয়ে শতাব্দীপ্রাচীন বাবরি মসজিদ মুহূর্তে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। লিবারহান কমিশনের ভাষায়, এটি “স্বতঃস্ফূর্ত নয়, বরং নিখুঁত পরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশ।”
কিন্তু ধ্বংসের ধুলো বসে গেলেই কি ইতিহাস থেমে যায়? না। বাবরি মসজিদের পতনের পর দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি নতুন এক পরিচয় সংকটে ঢুকে পড়ে। আইনের শাসন দুর্বল হলে কী ঘটে, প্রশাসনের নৈতিকতা ক্ষয় হলে সমাজ কোন দিকে গড়ায়—তার এক ভয়াবহ প্রতিচ্ছবি তৈরি হয় পরবর্তী বছরের দাঙ্গা, হত্যা ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তারে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য বলে, ১৯৯২ থেকে ২০০২ পর্যন্ত ভারতজুড়ে সহিংসতায় প্রাণ হারায় দুই হাজারেরও বেশি মানুষ—এ সংখ্যার প্রতি প্রাণই ছিল রাষ্ট্রীয় দুর্বলতার মাশুল।
২০১৯ সালের ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায় বিতর্ককে আরও জটিল করে। প্রত্নতাত্ত্বিক অস্পষ্টতা থাকা সত্ত্বেও বিতর্কিত ভূমি মন্দির নির্মাণের জন্য প্রদান করা হয় এবং মুসলমানদের অন্যত্র পাঁচ একর জমি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আইনগত রায় হলেও ইতিহাস, নৈতিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে তা আজও বিভক্তি সৃষ্টি করে।
আসলে ৬ ডিসেম্বর আমাদের সামনে যে প্রশ্নটি রাখে, তা রাজনীতির নয়—সভ্যতার।
রাষ্ট্র কি তার ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে সহাবস্থানের ভিত্তিতে, নাকি অতীতের ক্ষতকে রাজনৈতিক পুঁজি বানাবে? ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ যখন রাষ্ট্রচিন্তা নিয়ন্ত্রণ করে, তখন সমাজ ন্যায় নয়—ভয় ও অনিশ্চয়তার দিকে গড়ায়।
এই দিন তাই কেবল শোকের তারিখ নয়; এটি এক ঐতিহাসিক সতর্কবার্তা। ধ্বংসের ওপর কোনো সভ্যতার ভিত্তি গড়ে না। গড়ে যুক্তির দৃঢ়তা, ন্যায়বিচারের সাহস, বহুত্ববাদের নৈতিক শক্তি এবং নাগরিক সমতার নিশ্চয়তায়।
বাবরি ধ্বংস সেই সত্যটিই মনে করিয়ে দেয়: স্মৃতি যখন ক্ষতে পরিণত হয়, তখন তা কেবল অতীতের নয়—ভবিষ্যতের ভাগ্যও নির্ধারণ করে।
৬ ডিসেম্বর তাই একটি তারিখ নয়; এটি একটি সময়-উত্তীর্ণ প্রতিধ্বনি, যা দক্ষিণ এশিয়ার বুকে এখনও অমোচনীয় নখের আঁচড় এঁকে যায়।
লেখক: শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর
তথ্যসূত্র: এলফিনস্টোন স্মিথ, Archaeology of Oudh, 1877, উত্তর প্রদেশ সরকারি নথি, ১৯৪৯ মূর্তি স্থাপন ঘটনা, লিবারহান কমিশন রিপোর্ট, ভারত সরকার, ২০০৯, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিবেদন ১৯৯৩–২০০৩, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায়, Ayodhya Verdict, ২০১৯


