Logo
Logo
×

সম্পাদকীয়

(দ্বিতীয় পর্ব)

ভূখণ্ড নয়, আগামী দুনিয়া নিয়ন্ত্রিত হবে ডিজিটাল বর্ডারে

উপনিবেশিকতার নয়া ছকে বাংলাদেশ

মো. শহিদুল ইসলাম

মো. শহিদুল ইসলাম

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২৫, ১১:৪২ এএম

ভূখণ্ড নয়, আগামী দুনিয়া নিয়ন্ত্রিত হবে ডিজিটাল বর্ডারে

ডিজিটাল বর্ডার, ছবি: অনলাইন থেকে নেওয়া

ভূখণ্ডের সার্বভৈৗমত্বের সাথে এখন ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা খুবই জরুরি। ডিজিটাল সার্বভৈৗমত্ব ব্যতীত কোনো রাষ্ট্রই উপনিবেশিক শাসন ও শোষণ থেকে বের হতে পারবে না। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন ডিজিটাল মব ভায়োলেন্স, আন্দোলনের মিথ্যা তথ্য, ভিত্তিহীন প্রচার, প্রমোশন এগুলো রাষ্ট্রকে অরক্ষিত করে তুলছে। এভাবে একটি রাষ্ট্রকে কোনো প্রযুক্তির হাতে তুলে দিলে তারা আমাদেরকে নিয়ে তাদের উপনিবেশিক ধাঁচে পরিচালনা করবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ডেটা বা ডিজিটাল উপনিবেশিকতা দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। 

২০২৫ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশ (AMTOB) এর পরসিংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিলো ১৮ কোটির উপর। ১৪ কোটির বেশি মানুষ স্মার্টফোন , সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে সক্রিয় ও নির্ভরশীল। কিন্তু এই বিপুল ডেটা কোথায় যাচ্ছে? কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে? বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের এখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বিদেশি সার্ভারে সংরক্ষিত। আমরা নিজেদের শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় ক্লাউড পরিকাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। যা করেছি , অত্যন্ত দুর্বল। প্রযুক্তিগত শক্তিশালী আইনি কাঠামোও তৈরি করতে পারিনি। যা কার হয়েছে, তা রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনে ব্যবহার হয়। গুগল, মেটা, অ্যামাজন, টিকটক বা এক্স ইত্যাদি সবকিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে। এর ফলে আমাদের জনগণের আচরণ, ভোগপণ্য প্রবণতা, রাজনৈতিক অবস্থানসহ সব কিছুই চলে যাচ্ছে বিদেশি কর্পোরেটদের হাতে। শক্তিশালী নিরাপত্তা নীতিমালা বা তথ্য-অধিকার আইন না থাকলে, একটি রাষ্ট্র কার্যত “ডিজিটাল উপনিবেশ” হয়ে পড়ে। আমাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট উন্নত এবং ব্যবহার বাড়াতে হবে। কিন্তু আমরা দিনে দিনে সেদিকে না হেটে বা কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে বিদেশি স্যাটেলাইট নির্ভর হয়ে পড়ছি। সম্প্রতি আমরা এই ভূখণ্ডের ডিজিটাল সার্বভৌমত্বে স্টারলিংককেও প্রবেশাধিকার দিয়েছি। সেই প্রবেশাধিকার সম্পর্কে জনগণের ধারণা খুবই অপ্রতুল।  বিশ্বের মধ্যে চীন এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। চীন উন্নত, বিস্তৃত ও কৌশলগতভাবে নিজেই রাষ্ট্র-নিয়িন্ত্রিত ডিজিটাল ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে।   

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

ডেটা বা ডিজিটাল উপনিবেশিকতার সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো এটির চেহারা হীন ও নীরব। কোনো সেনাবাহিনী দরকার নেই, শুধু একটি অ্যাপ ইন্সটল করলেই আপনি হয়ে উঠতে পারেন তথ্যের দাস। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এই তথ্য আরও ভয়ংকর যে, ভোটার প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে কে কোথায় কী ভাবছে, তা আগেই জানা যায়। ফেক নিউজ, ডিজিটাল প্রচারণা, এবং মাইক্রো-টার্গেটিংয়ের মাধ্যমে নির্বাচন পর্যন্ত প্রভাবিত করা সম্ভব হয়। 

বিশ্বখ্যাত মার্কিন সমাজতাত্ত্বিক ও গবেষক শোশানা জুবফ (Shoshana Zuboff)  তার বই The Age of Surveillance Capitalism-এ বলেছেন, এখন মানুষ আর প্রযুক্তির ব্যবহারকারী নয়, বরং মানুষ নিজেই হয়ে উঠছে প্রযুক্তির কাঁচামাল। তার আচরণ, অভ্যাস, আবেগ সবকিছু পরিণত হচ্ছে বিশ্লেষণযোগ্য ডেটায়, যা বিক্রি হয় করপোরেট ও রাজনৈতিক লাভের জন্য। বাংলাদেশ যেহেতু প্রযুক্তি উৎপাদক দেশ নয়, বরং ব্যবহারকারী দেশ, তাই এই পরিণতির শিকার হওয়ার ঝুঁকি আরও বেশি। 

ডিজিটাল উপনিবেশিকতার একটি নিঃশব্দ প্রভাব হলো সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। বিদেশি অ্যালগরিদম আমাদের সামনে কোন গান, কোন চলচ্চিত্র, কোন খবর বা কোন ভাবনা তুলে ধরবে, তা ঠিক করে দেয়। এর ফলে ধীরে ধীরে দেশীয় ভাষা, ভাবনা ও সংস্কৃতি প্রান্তিক হয়ে পড়ে। তরুণ প্রজন্মের তথ্য গ্রহণ ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা আর নিজের সমাজ থেকে জন্ম নিচ্ছে না, বরং এক আন্তর্জাতিক করপোরেট কাঠামোর ফিল্টার হয়ে আসছে। তাইতো আমরা আমাদের পরিবেশ প্রাণপ্রকৃতির উন্নয়নের দিকে না ঝুঁকে দেশটাকে ইট-কাট পাথরে ভরে দিচ্ছি। আমাদের সকল উন্নয়নে পরিবেশ প্রাণ প্রকৃতি, বাংলাদেশের ভৌগোলিক, জাতীয়তা এবং বহুজাতি গোষ্ঠীর ভাবধারাকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো জনবিমুখী ও জনবিবিচ্ছিন্ন হবার কারণে, তা বন্ধে আবার জনগণকে আন্দোলন করতে হয়। ডিজিটাল উপনিবেশিকতা আমাদেরকে Divide and Rule (বিভক্ত করো ও শাসন করো) প্রক্রিয়া-পদ্ধতিকে এগিয়ে দিচ্ছে। যার ফলে বহুবৈচিত্র্য বাংলাদেশের মতো একটি দেশে ধর্ম, ভাষা, জাতি, শ্রেণি বা রাজনৈতিক মতাদর্শে ভাগ করে পারস্পরিক বিরোধ তৈরি করা হচ্ছে। যাতে আমরা পরস্পর লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকি এবং উপনিবেশিক শাসক অনায়াসে আমাদের উপর কর্তত্ব বজায় রাখতে পারে।   

প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশ কি ডিজিটাল উপনিবেশিকতার শিকার? দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, হ্যাঁ। কারণ তথ্য ও প্রযুক্তির মাধ্যমে এক অদৃশ্য শাসন ব্যবস্থায় আমরা আটকে গেছি, যার প্রভাব অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও জাতীয় নিরাপত্তায়ও ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এই পরিস্থিতি অপরিবর্তনীয় নয়। প্রথমত, তথ্য-সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে হবে। দেশের নাগরিকদের তথ্য দেশীয় সার্ভারে সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন অপরিহার্য। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রীয়ভাবে নিজস্ব জাতীয় ক্লাউড অবকাঠামো ও সাইবার নিরাপত্তা কাঠামো শক্তিশালীভাবে গড়ে তুলতে হবে। তৃতীয়ত, শিক্ষাব্যবস্থায় ডেটা লিটারেসি বা তথ্য সচেতনতা যুক্ত করতে হবে, যাতে তরুণরা জানে তারা কীভাবে নিজস্ব তথ্যের অধিকার রক্ষা করতে পারে। 

আমাদের মনে রাখতে হবে, আজকের পৃথিবীতে আরেকটি জাতিকে দখল করার জন্য সেনাবাহিনী পাঠানো লাগে না। শুধু তাদের তথ্যের ওপর কর্তৃত্ব অর্জন করলেই তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর সেই নিয়ন্ত্রণটাই হলো নতুন উপনিবেশ-ডিজিটাল উপনিবেশিকতা।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও পরিবেশ আইন গবেষক

ইমেইল: rshahid_546@yahoo.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম