Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

যৌথ শিক্ষা ব্যবস্থায় সহপাঠীদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ ও যোগাযোগের সীমারেখা কতটুকু

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৩৪ পিএম

যৌথ শিক্ষা ব্যবস্থায় সহপাঠীদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ ও যোগাযোগের সীমারেখা কতটুকু

যৌথ শিক্ষা ও নৈতিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে বিস্তারিত। সংগৃহীত ছবি

সমাজ পরিবর্তনের দ্রুত প্রবাহে শিক্ষা আজ বিশ্বায়নের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আধুনিক সভ্যতার অগ্রযাত্রায় নারী ও পুরুষ একসঙ্গে শিক্ষালাভ করছে, একসঙ্গে কাজ করছে, এবং একে অপরের সহযোগিতায় নতুন জ্ঞান ও প্রযুক্তি সৃষ্টি করছে। 

এই বাস্তবতার ভেতরেই ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে একটি সূক্ষ্ম প্রশ্ন মাথা তোলে যৌথ শিক্ষা ব্যবস্থায় সহপাঠীদের দেখা-সাক্ষাৎ ও পারস্পরিক যোগাযোগের সীমারেখা কোথায়? 

ইসলাম জ্ঞানকে সবচেয়ে মহিমান্বিত বিষয় হিসেবে ঘোষণা করেছে। মহান আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে প্রথম যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা হলো ‘পড়ো, তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’। (সূরা আলাক ১) 

এই আয়াতের মাধ্যমে ইসলাম শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রতি যে উৎসাহ দিয়েছে, তার তুলনা মানব ইতিহাসে বিরল। কিন্তু ইসলাম কখনও জ্ঞানকে নৈতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করেনি। বরং জ্ঞানের আলো তখনই আলোকিত হয়, যখন তা নৈতিকতার শুদ্ধ ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। 

ইমাম গাজ্জালী রহ. তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন’ এ বলেছেন, ‘জ্ঞান এমন এক আলো, যা হৃদয়ে স্থাপিত হয়। আর যখন হৃদয় নফসের কামনায় কলুষিত হয়, তখন সেই আলো নিভে যায়’। 

গাজ্জালীর এই উক্তি আমাদের মনে করিয়ে দেয় শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য শুধুমাত্র তথ্য অর্জন নয়, বরং আত্মশুদ্ধি ও সমাজে আলোকিত পরিবর্তন আনা। সেই শিক্ষার পরিবেশ যদি নৈতিক ভারসাম্য হারায়, তবে সেখানে জ্ঞানের বরকতও বিলীন হয়ে যায়। 

সহশিক্ষা বা যৌথ শিক্ষা ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য জ্ঞান বিনিময়, কিন্তু বাস্তবে সেখানে নারী ও পুরুষের সহাবস্থান ঘটায় পারস্পরিক সম্পর্ক ও আচরণের একটি শৃঙ্খলা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ইসলাম এই সহাবস্থানকে অস্বীকার করেনি, বরং তাকে নৈতিকতার সীমায় বেঁধে দিয়েছে। 

আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন, ‘মুমিন পুরুষদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করে, এবং মুমিন নারীদের বলো, তারাও যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে।’ (সূরা আন-নূর: ৩০–৩১) 

এই আয়াত দুটি ইসলামী সমাজে নারী ও পুরুষের সম্পর্কের ভিত্তি স্থির করে দিয়েছে। এখানে দেখা-সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করা হয়নি, বরং পর্দা, সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের এক সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। 

ইমাম নববী রহ. বলেন, “যেখানে পুরুষ ও নারী একত্র হয়, সেখানে দৃষ্টির সংযমই সবচেয়ে বড় ফিতনা প্রতিরোধক”। অর্থাৎ ইসলামে সহাবস্থানকে অগ্রাহ্য নয়, বরং নৈতিকতার সংরক্ষণকে সেখানে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। 

নবী করিম সা.-এর হাদিসে এসেছে, ‘পুরুষ যেন কোনো নারীর সঙ্গে নির্জনে অবস্থান না করে, কারণ তৃতীয় ব্যক্তি তখন শয়তান’। (তিরমিজি ২১৭৮) 

অর্থাৎ যেখানে যোগাযোগের উদ্দেশ্য একাডেমিক বা পেশাগত প্রয়োজনের বাইরে চলে যায়, সেখানে শয়তানের প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হয়। 

ইমাম মালিক রহ. বলেছেন, ‘যেখানে নারী ও পুরুষ একত্র হয়, সেখানে তাকওয়া ও হায়ার প্রাচীরই তাদের নিরাপদ রাখে।’

বাস্তবে সহশিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্র ও ছাত্রীদের মধ্যে যোগাযোগ তখনই নৈতিক ও গ্রহণযোগ্য হয়, যখন তা দায়িত্ববোধ ও জ্ঞানের সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। পারস্পরিক সম্মান, বিনয়, এবং চোখ-হৃদয়ের সংযমই সেখানে ইসলামী শিষ্টাচারের প্রকৃত প্রতিফলন। 

আধুনিক যুগের শিক্ষা ব্যবস্থায় নারী-পুরুষকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক করা বাস্তবিক অর্থে সব দেশে সম্ভব নয়। কিন্তু ইসলাম বাস্তবতাকে অস্বীকার করে না, বরং সেই বাস্তবতার মধ্যে নৈতিকতার দিকনির্দেশনা দেয়। 

তাই যৌথ শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও ইসলামি আদর্শ মেনে চলা সম্ভব, যদি শিক্ষার্থী উভয়েই পর্দার প্রতি সচেতন থাকে, শালীন ভঙ্গিতে প্রয়োজনীয় সীমার ভেতরেই কথাবার্তা সীমাবদ্ধ রাখে, এবং অহেতুক মেলামেশা বা অনাবশ্যক ঘনিষ্ঠতা থেকে বিরত থাকে। 

জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্র শুধু বই নয়, চরিত্রও এক ধরনের পাঠশালা। একজন শিক্ষার্থী যখন নিজের আচরণে নম্রতা, শালীনতা ও আত্মসম্মান বজায় রাখে, তখন সে শুধু নিজের জন্য নয় সমাজের জন্যও এক আদর্শ হয়ে ওঠে। কেননা, ইসলাম শুধু শিক্ষিত মানুষ তৈরি করতে চায় না, বরং নৈতিক মানুষ গড়তে চায়। 

এই আলোচনার অন্তিম সত্যটি হলো ইসলাম শিক্ষা ও হায়াকে মুখোমুখি করে না, বরং তাদের পরস্পর-পরিপূরক করে তোলে। 

মহানবী সা.বলেছেন, ‘হায়া ঈমানের একটি শাখা’। (বুখারি ৯) 

অর্থাৎ যেখানে হায়া আছে, সেখানে ঈমান আছে, আর যেখানে হায়া হারিয়ে যায়, সেখানে ঈমান দুর্বল হয়ে পড়ে। সহশিক্ষা ব্যবস্থায় দেখা-সাক্ষাৎ ও যোগাযোগের সীমারেখা তাই কেবল বাহ্যিক কোনো নিয়ম নয়, বরং হৃদয়ের গভীরে গড়ে তোলা এক নৈতিক প্রাচীর, যার নাম তাকওয়া। 

শিক্ষালয়ের আলো যেন নৈতিক অন্ধকারে নিভে না যায়, সেটাই ইসলামের মূল লক্ষ্য। জ্ঞান তখনই আলো হয়ে ওঠে, যখন তা মানবিকতা, বিনয় ও হায়ার আলোয় জ্বলে। তাই সহশিক্ষা থাকুক বা না থাকুক, ইসলামের চোখে প্রকৃত শিক্ষা সেই, যা মানুষকে জ্ঞানের পাশাপাশি নৈতিকতায়ও পূর্ণতা দেয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম