Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী?

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ১২:২৩ পিএম

পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী?

ইসলামে সন্তান গ্রহণ বা বিলম্বিত করার ক্ষেত্রে নৈতিক ও ন্যায্য উদ্দেশ্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ছবি: সংগৃহীত

মানুষের জীবনের সবচেয়ে কোমল অথচ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো পরিবার। সেই পরিবারে নতুন প্রাণের আগমন যেন আল্লাহর রহমতের এক ঝলক যেখানে দুনিয়ার কোলাহলের মাঝেও ভেসে আসে স্বর্গীয় প্রশান্তি। 

কিন্তু আধুনিক সময় এসে এই অনন্ত আশীর্বাদকে দাঁড় করিয়েছে প্রশ্নের মুখে—সন্তান ক’জন হবে, তা কি নির্ধারণ করবে মানুষ, না আল্লাহ? 

ইসলাম এই প্রশ্নের জবাবে কোনো একপাক্ষিক ফতোয়া দেয় না। বরং দেয় পরিমিতির শিক্ষা—যা নিষিদ্ধ নয়, তবে সীমাহীনও নয়। পরিবার পরিকল্পনা ইসলামের দৃষ্টিতে ‘সন্তাননিরোধ’ নয়, বরং ‘দায়িত্ববোধের প্রকাশ’। 

কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের দারিদ্র্যের ভয়ে হত্যা করো না; আমি তাদেরও রিজিক দিই, তোমাদেরও।’ (সুরা আল-ইসরা, আয়াত ৩১)

এই আয়াতের অন্তর্নিহিত বার্তা স্পষ্ট—সন্তান জন্মকে ভয় নয়, বরং বিশ্বাসের জায়গা থেকে দেখতে হবে। রিজিকের মালিক একমাত্র আল্লাহ, তার কৃপা ছাড়া কোনো সন্তানই পৃথিবীতে শ্বাস নিতে পারে না। তবে এর মানে এই নয় যে ইসলাম চিন্তাশীল পরিকল্পনার বিরোধী। বরং ইসলাম শেখায় প্রতিটি সিদ্ধান্ত হতে হবে হিকমাহ ও ন্যায়বোধের আলোকে। 

রাসুলুল্লাহ সা. এর যুগেই সাহাবিরা ‘আজল’ (সহবাসের সময় বীর্যপাত রোধ করে গর্ভধারণ প্রতিরোধ) প্রথা অবলম্বন করতেন। 

ইমাম মুসলিম রহ. বর্ণনা করেন, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ সা. এর জীবদ্দশায় আজল করতাম, এবং তিনি তা নিষেধ করেননি।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস ১৪৪০)

এখানে রাসুল সা. এর অনুমোদন এক মৌলিক নীতিকে স্পষ্ট করে গর্ভধারণ বিলম্বিত করা বৈধ, যদি উদ্দেশ্য হয় ন্যায্য ও নৈতিক। যেমন: স্ত্রীর শারীরিক দুর্বলতা, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, কিংবা পূর্ববর্তী সন্তানদের সঠিক লালন–পালনের প্রয়াস। 

ইমাম গাযালী রহ. ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন-এ বলেন, ‘আজল বৈধ, যদি তা নৈতিক কারণে হয় এবং স্ত্রীর সম্মতি থাকে।’ 

ইমাম ইবনু কাইয়্যিম রহ. মন্তব্য করেন, ‘পরিবার পরিকল্পনা তখনই গ্রহণযোগ্য, যখন তা আল্লাহর বিধানের সীমা অতিক্রম করে না এবং মানুষের ঈমান দুর্বল করে না।’

অতএব, ইসলামের মূলনীতি হলো পরিবার পরিকল্পনা চলবে উদ্দেশ্য ও সীমার ভেতর। যদি কেউ কেবল ভোগবিলাস বা দুনিয়ার স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় সন্তান জন্ম বিলম্বিত করে, তবে তা ঈমানের পরিপন্থী।কিন্তু যদি উদ্দেশ্য হয় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এবং সন্তানের মান রক্ষা তবে তা এক ধরণের আমানত রক্ষার বুদ্ধিমত্তা। 

আজকের পৃথিবীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ভয় কিংবা দারিদ্র্যের আতঙ্ক আমাদের অনেক সময় অবিশ্বাসের দরজায় নিয়ে যায়। অথচ ইসলাম বলে সন্তান সংখ্যা নয়, সন্তানমানেই জাতির শক্তি। 

পরিবার কোনো ভার নয়, এটি দায়িত্বের বাগান, যেখানে প্রতিটি সন্তান ফুল হয়ে ফুটে, যদি অভিভাবক হন মালী আর আল্লাহ হন পথপ্রদর্শক। 

অতএব, পরিবার পরিকল্পনা মানে নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং এক সুপরিকল্পিত আমানতের সুরক্ষা যেখানে হিসাবের ক্যালকুলেটরের আগে থাকে হৃদয়ের ঈমান, আর পরিকল্পনার আগে থাকে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস।

জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি নিয়ে আলেমদের মতামত

মৌলিকভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রণে প্রচলিত তিনটি পদ্ধতি পাওয়া যায়—

এক. স্থায়ী ব্যবস্থা : জন্ম নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যার দ্বারা নারী বা পুরুষ প্রজননক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। যেমন—পুরুষের জন্য ভ্যাসেকটমি ও মহিলাদের জন্য লাইগেশন। এ ব্যবস্থায় অপারেশনের মাধ্যমে পুরুষ বা নারীর সন্তান দেওয়ার ও নেওয়ার ব্যবস্থা চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়। 

এই পদ্ধতি গ্রহণ সম্পূর্ণ অবৈধ। এতে আল্লাহর সৃষ্টির পরিবর্তন করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। 

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, আমরা রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে জিহাদে অংশ নিতাম। কিন্তু আমাদের কোনো কিছু ছিল না। সুতরাং আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে বললাম, আমরা কি খাসি হয়ে যাব? 

তিনি আমাদের খাসি হতে নিষেধ করলেন এবং কোনো মহিলার সঙ্গে একখানা কাপড়ের বিনিময়ে হলেও শাদী করার অনুমতি দিলেন এবং আমাদের এই আয়াত পাঠ করে শোনালেন, হে মুমিনরা! আল্লাহ যে পবিত্র জিনিসগুলো তোমাদের জন্য হালাল করেছেন তোমরা তা হারাম কোরো না এবং সীমা লঙ্ঘন কোরো না। আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না। (বুখারি, হাদিস : ৪৭০৯)

দুই. মেয়াদি ব্যবস্থা: যেমন—নির্ধারিত মেয়াদের জন্য ইনজেকশন, নিরাপদকাল মেনে চলা, আইইউডি ব্যবহার করা ইত্যাদি। এই পদ্ধতি গ্রহণ করা মাকরুহ তাহরিমি। আর মাকরুহ তাহরিমি হারামের কাছাকাছি।

তিন. সাময়িক ব্যবস্থা: যেমন—কনডম ব্যবহার করা, জন্ম নিরোধক পিল ব্যবহার করা ইত্যাদি। এই পদ্ধতি যদি স্ত্রী বা সন্তানের স্বাস্থ্য রক্ষার প্রয়োজনে অভিজ্ঞ দ্বিনদার ডাক্তারের পরামর্শক্রমে গ্রহণ করা হয় তাহলে তা জায়েজ। 

এই পদ্ধতি যদি বিলাসিতার উদ্দেশে গ্রহণ করা হয় এই ভেবে যে সন্তান কম হলে ঝামেলা কম হবে, ছিমছাম থাকা যাবে ইত্যাদি, তাহলে স্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে তা গ্রহণ করা জায়েজ, তবে এটা অনুত্তম। (আহকামে জিন্দেগী : ৫৫৮)

জন্ম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মুসলিম দম্পতিদের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং প্রয়োজনে ইসলামী বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।

লেখক: শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম