Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

যে সতর্কবার্তা মুমিনের হৃদয়কে জাগিয়ে দেয়

Icon

ইসলাম ও জীবন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৪:৪৩ পিএম

যে সতর্কবার্তা মুমিনের হৃদয়কে জাগিয়ে দেয়

ছবি: সংগৃহীত

মানুষ ভুল করে, ভুলে যায়, পাপ করে—আবার আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়। কিন্তু যে জিনিসটি মুমিনকে বারবার জাগিয়ে দেয়, তাকে পুনরায় আল্লাহর পথে ফিরিয়ে আনে—তা হলো আল্লাহর শাস্তির চিন্তা, বিশেষ করে জাহান্নামের ভয়। জাহান্নামের আজাবের কথা শুনলেই মুমিনের অন্তর কেঁপে ওঠে। কারণ পাপ করতে করতে যদি হৃদয় কঠোর হয়ে যায়, তবে জাহান্নামের সতর্কবার্তা সেই হৃদয়কে নরম করে দেয়। এক মুহূর্তের আগুনও মানুষ সহ্য করতে পারে না— তাহলে কিভাবে সহ্য করবে সেই আগুন, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর?

আল্লাহ তাআলা ও তার রাসুল (সা.) জাহান্নামের ভয়াবহতা বর্ণনা করেছেন, যাতে মানুষ গুনাহ থেকে দূরে থাকে এবং আল্লাহর রহমতের ছায়ায় নিরাপত্তা খুঁজে পায়। কুরআন-সুন্নাহর আলোকে জাহান্নামের ভয়াবহতা তুলে ধরা হলো—

কুরআনের আলোকে জাহান্নামের ভয়াবহতা

১. মানুষ ও পাথর যে আগুনের জ্বালানি

ভাবুন— মানুষ ও পাথরের উপরই যদি আগুন জ্বালানো হয়, তাহলে এই আগুনের তাপ কত ভয়ংকর হবে! আল্লাহ তাআলা বিষয়টি কুরআনে এভাবে উপস্থাপন করেছেন—

فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ

‘সেই আগুন থেকে বেঁচে থাকো, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর।’ (সুরা বাকারা: আয়াত ২৪)

২. জাহান্নামের আগুনের তীব্রতা

দুনিয়ার আগুন যদি এত ভয়ংকর হয়, তাহলে জাহান্নামের আগুন কেমন হবে? এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন—

قُلْ نَارُ جَهَنَّمَ أَشَدُّ حَرًّا

‘বলুন, জাহান্নামের আগুন আরও তীব্রতর।’ (সুরা তাওবা: আয়াত ৮১)

৩. জাহান্নামের গর্জন

জাহান্নাম নিজেই অপরাধীদের দিকে ক্রুদ্ধ (রাগান্বিত) হয়ে গর্জন করে উঠবে। আল্লাহ তাআলা বলেন—

إِذَا رَأَتْهُم مِّن مَّكَانٍۢ بَعِيدٍۢ سَمِعُوا لَهَا تَغَيُّظًا وَزَفِيرًا

‘যখন জাহান্নাম তাদের দূর থেকে দেখবে, তখন তারা তার প্রচণ্ড ক্রোধ ও গর্জন শুনবে।’ (সুরা ফুরকান: আয়াত ১২)

৪. জাহান্নামের পাহারাদার

ভয়ংকর সব ফেরেশতারা হবে জাহান্নামের পাহারাদার। তাদের দয়া নেই। তারা শুধু আল্লাহর নির্দেশ পালন করে। আল্লাহ তাআলা বলেন—

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا قُوۡۤا اَنۡفُسَكُمۡ وَ اَهۡلِیۡكُمۡ نَارًا وَّ قُوۡدُهَا النَّاسُ وَ الۡحِجَارَۃُ عَلَیۡهَا مَلٰٓئِكَۃٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَّا یَعۡصُوۡنَ اللّٰهَ مَاۤ اَمَرَهُمۡ وَ یَفۡعَلُوۡنَ مَا یُؤۡمَرُوۡنَ

‘হে ইমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে (জাহান্নামের) আগুন থেকে বাঁচাও; যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর; যেখানে রয়েছে নির্মম ও কঠোর ফেরেশতাকূল, আল্লাহ তাদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছেন তারা সে ব্যাপারে তার অবাধ্য হয় না। আর তারা তা-ই করে যা তাদেরকে আদেশ করা হয়।’ (সুরা তাহরিম: আয়াত ৬)

হাদিসের আলোকে জাহান্নামের ভয়াবহতা

৫. ৭০ গুণ বেশি ভয়াবহ আগুন

দুনিয়ার আগুনের সামান্য স্পর্শই মানুষ সহ্য করতে পারে না— এ আগুন যখন ৭০ গুণ বেশি অবস্থা ধারণ করবে তখন কী অবস্থা হবে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

نَارُكُمْ هَذِهِ الَّتِي يُوقِدُ ابْنُ آدَمَ جُزْءٌ مِنْ سَبْعِينَ جُزْءًا مِنْ حَرِّ جَهَنَّمَ –‏ قَالُوا وَاللَّهِ إِنْ كَانَتْ لَكَافِيَةً يَا رَسُولَ اللَّهِ ‏قَالَ – فَإِنَّهَا فُضِّلَتْ عَلَيْهَا بِتِسْعَةٍ وَسِتِّينَ جُزْءًا كُلُّهَا مِثْلُ حَرِّهَا

‘তোমাদের এ অগ্নি যা আদম সন্তানগণ জ্বলিয়ে থাকে তা জাহান্নামের অগ্নির উত্তাপের সত্তর ভাগের একভাগ। সাহাবাগণ বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহর কসম! এ আগুনই তো যথেষ্ট ছিল? তিনি বললেন, সে আগুন তো এ আগুনের তুলনায় উনসত্তর গুণ অধিক তাপমাত্রা সম্পন্ন। এ উনসত্তরের প্রতিটি তাপমাত্রাই দুনিয়ার আগুনের তাপমাত্রার সমতুল্য।’ (মুসলিম ৭০৫৭)

৬. সবচেয়ে হালকা শাস্তিও অসহনীয়

ভাবুন— পায়ের নিচে থাকবে আগুনের অঙ্গার। যার ফলে মস্তিষ্ক ফুটতে থাকবে। এটি হবে সবচেয়ে কম শাস্তি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

إِنَّ أَهْوَنَ أَهْلِ النَّارِ عَذَابًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ لَرَجُلٌ تُوضَعُ فِي أَخْمَصِ قَدَمَيْهِ جَمْرَتَانِ يَغْلِي مِنْهُمَا دِمَاغُهُ

‘কিয়ামত দিবসে জাহান্নামীদের মধ্যে সবচেয়ে হালকা শাস্তি হবে ওই ব্যক্তির, যার দুপায়ের তলায় দুটি (জ্বলন্ত) অঙ্গার রাখা হবে, যার কারণে তার মগজ উথলাতে থাকবে।’ (মুসলিম ৪০৯ ইফা)

অন্য বর্ণনায় এসেছে—

إِنَّ أَدْنَى أَهْلِ النَّارِ عَذَابًا يَنْتَعِلُ بِنَعْلَيْنِ مِنْ نَارٍ يَغْلِي دِمَاغُهُ مِنْ حَرَارَةِ نَعْلَيْهِ

‘জাহান্নামের সবচেয়ে কম আযাব সে ব্যাক্তির হবে, যাকে আগুনের দুটি জুতা পরানো হবে, ফলে এই দুটির কারণে তার মগজ উথলাতে থাকবে।’ (মুসলিম ৪০৭ ইফা)

৭. জাহান্নাম বলবে: ‘আরও আছে কি?’

জাহান্নামের তৃষ্ণা কখনো পূর্ণ হবে না। জাহান্নামে যত অপরাধীকে নিক্ষেপ করা হোক না কেন, জাহান্নাম বলতে থাকবে আরও আছে কি? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

لَا تَزَالُ جَهَنَّمَ يُلْقَى فِيهَا وَتَقُولُ: هَلْ مِنْ مَزِيدٍ؟ حَتَّى يَضَعَ رَبُّ العزَّةِ فِيهَا قدَمَه فينزَوي بَعْضُهَا إِلَى بَعْضٍ فَتَقُولُ: قَطْ قَطْ بِعِزَّتِكَ وَكَرَمِكَ وَلَا يَزَالُ فِي الْجَنَّةِ فَضْلٌ حَتَّى يُنْشِئَ اللَّهُ لَهَا خَلْقًا فَيُسْكِنُهُمْ فَضْلَ الْجَنَّةِ 

‘জাহান্নামে অবিরাম (জিন-ইনসানকে) নিক্ষেপ করা হবে। তখন জাহান্নাম বলতে থাকবে, আরও বেশি কিছু আছে কি? এভাবে ততক্ষণ পর্যন্ত বলতে থাকবে, যতক্ষণ না মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তার মধ্যে নিজের পবিত্র পা রাখবেন। তখন জাহান্নামের একাংশ অপর অংশের সঙ্গে চেপে যাবে এবং বলবে, তোমার মর্যাদা ও অনুগ্রহের শপথ। যথেষ্ট হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে। আর জান্নাতের মধ্যে লোকেদের প্রবেশের পরও অতিরিক্ত স্থান থেকে যাবে, এমনকি আল্লাহ তাআলা তার জন্য নতুন নতুন সৃষ্টজীব সৃষ্টি করে তাদেরকে জান্নাতের সেই সমস্ত খালি স্থানে অবস্থান করাবেন।’ (বুখারি ৪৮৪৮ ও মুসলিম ২৮৪৮, তিরমিজি ৩২৭২, মুসনাদে আহমাদ ১৪০০০, সহীহুল জামি ৭২৮৬, মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ২০৮৯৩, মুসনাদে আবদ ইবনু হুমায়দ ৯০৮, ইবনু হিব্বান ২৬৮, নাসাঈ ৭৭১৯, দারিমী ২৮৪৯, মিশকাত ৫৬৯৫)

জাহান্নামের ভয় মুমিনকে অমানবিক করে না, বরং তাকে সবচেয়ে মানবিক, বিনয়ী ও পরহেজগার বানায়। তাইতো জাহান্নামের ভয় মুমিন মুসলমানের জন্য রহমত। কেননা জাহান্নামের ভয় মানুষকে—

> গুনাহ থেকে ফিরিয়ে আনে

> তাওবা ও ইস্তেগফারে মনোযোগী করে তোলে

> জীবনের মূল্য স্মরণ করিয়ে দেয়

> আল্লাহর কাছাকাছি নিয়ে যায়

> মুমিনের হৃদয় নরম হয়, আচরণ সুন্দর হয়

পরিশেষে জাহান্নামের ভয় কোনো হতাশার বার্তা নয়, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় সতর্কবার্তা, যাতে আমরা নিজেরা ধ্বংসের পথে না যাই। আল্লাহ চান তার বান্দা জাহান্নাম থেকে বাঁচুক, তাইতো তিনি কুরআনে বারবার সতর্ক করেছেন, নবীজি (সা.) বারবার কেঁদে কেঁদে দোয়া করেছেন, সাহাবারা এত বেশি ভয় পেতেন। তাই মুমিনের কাজ হলো— গুনাহ থেকে দূরে থাকা, তাওবা করা এবং আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে জাহান্নামের আগুন থেকে নিরাপদ রাখুন, আমাদের অন্তর নরম করুন এবং আমলকে সুন্দর করুন। আল্লাহকে করুণার স্বরে ডাকুন আর বলুন—

اللَّهُمَّ أَجِرْنَا مِنَ النَّارِ

উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা আঝিরনা মিনান নার।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমাদেরকে (জাহান্নামের) আগুন থেকে রক্ষা করুন। آمين يا رب العالمين

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম