ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নবিজীর (সা.) ঐতিহাসিক ঘোষণা কী ছিল?
ইসলাম ও জীবন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৩০ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ইনসাফ বা ন্যায়বিচার ইসলামে সর্বোচ্চ মূল্যবান নীতি। এটি শুধু অপরিচিত বা দূরের মানুষের ক্ষেত্রে নয়, বরং নিকটাত্মীয়ের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। পরিবারের সদস্য, আত্মীয় বা প্রিয়জনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা অবস্থাতেও বিচার করতে গিয়ে পক্ষপাত গ্রহণ করা ইসলাম অনুমোদন করে না। ন্যায়বিচারের মূল লক্ষ্যই হলো সত্য ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করা, যা সমাজে স্থায়ী শান্তি ও সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য। ইনসাফ (ন্যায়বিচার) বিষয়ে নবিজীর (সা.) ঐতিহাসিক ঘোষণাসহ কয়েকটি সুন্দর, হৃদয়গ্রাহী ও শিক্ষামূলক উদাহরণ তুলে ধরা হলো—
১. রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর ন্যায়বিচার (চুরির ঘটনায়)
বনু মাখযুম গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত নারীর চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিছু সাহাবি তার শাস্তি লঘু করার সুপারিশ করলে রাসুলুল্লাহ (সা.) অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বক্তব্য দেন। হাদিসটি হুবহু তুলে ধরা হলো—
أَنَّ قُرَيْشًا أَهَمَّهُمْ شَأْنُ الْمَرْأَةِ الْمَخْزُومِيَّةِ الَّتِي سَرَقَتْ، فَقَالُوا: مَنْ يُكَلِّمُ فِيهَا؟ يَعْنِي رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالُوا: وَمَنْ يَجْتَرِئُ إِلَّا أُسَامَةُ بْنُ زَيْدٍ، حِبُّ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ فَكَلَّمَهُ أُسَامَةُ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَا أُسَامَةُ، أَتَشْفَعُ فِي حَدٍّ مِنْ حُدُودِ اللَّهِ؟ ثُمَّ قَامَ فَاخْتَطَبَ، فَقَالَ: إِنَّمَا هَلَكَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ أَنَّهُمْ كَانُوا إِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الشَّرِيفُ تَرَكُوهُ، وَإِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الضَّعِيفُ أَقَامُوا عَلَيْهِ الْحَدَّ، وَايْمُ اللَّهِ، لَوْ أَنَّ فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَرَقَتْ، لَقَطَعْتُ يَدَهَا
‘মাখযুমি গোত্রের নারীর চুরি সংক্রান্ত অপরাধ কুরাইশদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুললে তারা বলল, এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে কে আলোচনা করবে? তারা বলল, নবী (সা.)-এর প্রিয়পাত্র উসামা ইবনু যায়িদই এ প্রসঙ্গে কথা বলতে সাহস করতে পারে। অতঃপর উসামা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে একথা বলাতে তিনি (সা.) বলেন— হে উসামা! তুমি কি মহান আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তি মওকুফের সুপারিশ করছো? অতঃপর তিনি ভাষণ দিতে দাঁড়িয়ে বলেন— তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির এজন্য ধ্বংস হয়েছে যে, তাদের মধ্যকার মর্যাদাশীল কেউ চুরি করলে তারা তাকে ছেড়ে দিতো, আর তাদের দুর্বল কেউ চুরি করলে তার ওপর শাস্তি বাস্তবায়িত করতো। আমি আমার আল্লাহর কসম করে বলছি! মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমাহও যদি চুরি করতো, তাহলে অবশ্যই আমি তার হাত কাটতাম।’ (আবু দাউদ ৪৩৭৩)
শিক্ষা: নবিজী (সা.)-এর এ ঐতিহাসিক ঘোষণায় স্পষ্ট হয় যে আইনের চোখে সবাই সমান। এমনকি নবী (সা.)–এর পরিবারও এর বাইরে নয়।
২. মক্কা বিজয়ের দিন সর্বোচ্চ ইনসাফ
মক্কা বিজয়ের দিনে নবী (সা.) তার পূর্বের শত্রু কুরাইশদের উদ্দেশ্যে কুরআনের বাক্য ব্যবহার করে ঘোষণা করেন—
لَا تَثْرِيبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ
‘আজ তোমাদের ওপর কোনো ভর্ৎসনা বা প্রতিশোধ নেই।’ (সুরা ইউসুফ: আয়াত ৯২)
হাদিস ও সিরাত গ্রন্থের বর্ণনায় মক্কাবাসীর প্রতি নবিজী (সা.)-এর ঘোষণা ছিল এরকম—
اذْهَبُوا فَأَنْتُمُ الطُّلَقَاءُ
‘তোমরা চলে যাও, তোমরা সবাই মুক্ত।’
শিক্ষা: প্রকৃত ইনসাফ শুধু হত্যা-শাস্তিতে নয়— সুযোগ মতো ক্ষমা করাও ইনসাফেরই অংশ।
৩. হজরত ওমর (রা.)– এর ইনসাফ
এক ব্যক্তি হজরত ওমর (রা.)-এর কাছে অভিযোগ করল যে, তার ছেলে মদ পান করেছে। ওমর (রা.) রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া সত্ত্বেও নিজ ছেলেকেই হাদ (শরিয়তের নিয়ম ও নির্দেশ) অনুযায়ী শাস্তি দিলেন। বিচারের ক্ষেত্রে পুত্র হিসেবে তার প্রতি কোনো ধরনের সহানুভূতি দেখাননি।
শিক্ষা: ন্যায়বিচার নিকটাত্মীয়ের ক্ষেত্রেও একই—কারো প্রতি পক্ষপাত নয়।
৪. হজরত আলী (রা.) ও ইহুদির বিচার
এক ইহুদির সঙ্গে হজরত আলী (রা.)-এর বর্ম নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। মামলা বিচারকের কাছে গেলে বিচারক আলী (রা.)-কে সাক্ষী দিতে বলেন।
আলী (রা.) বললেন— ‘আমার ছেলে সাক্ষী হবে।’
বিচারক বললেন— ‘ছেলে বাবার পক্ষে সাক্ষী হতে পারে না।’
অতঃপর ইহুদির পক্ষে রায় যায় এবং বিচার দেখে ইহুদি ইসলাম গ্রহণ করে।
শিক্ষা: বিচারপর্বে ‘পরিচয়-সম্পর্ক’ প্রভাব ফেলতে পারে না। সত্যই বিজয়ী।
৫. একজন মুমিন ব্যবসায়ীর ইনসাফ
এক ব্যবসায়ী যখন দেখে ক্রেতা দাম জানে না, তখন ইচ্ছা করলেই সে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে পারে। কিন্তু সে বলে—
‘ভাই, এই জিনিসের প্রকৃত দাম এতটুকু।’
শিক্ষা: লেনদেনের ইনসাফও ন্যয়বিচারের বড় অংশ।
৬. দুই মানুষের বিরোধে ন্যয়
দুই লোক বিচারকের কাছে এলো। বিচারক এক পক্ষের কথা শোনার পর সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত দেন না। বরং বলেন—
‘আমি এক পক্ষের কথা শুনে অন্য পক্ষকে না শুনে রায় দেব না।’
শিক্ষা: পক্ষ না শুনে সিদ্ধান্ত দেওয়া ইনসাফ নয়। বরং উভয় পক্ষের কথা শোনার পরই আসবে ইনসাফপূর্ণ রায়।
সুতরাং, ন্যায়বিচারের আদর্শ হলো সর্বজনীন—নিকটাত্মীয় হোক বা অচেনা, সবার সঙ্গে একই ন্যায্য আচরণ করা অপরিহার্য। পক্ষপাতিত্ব বা ব্যক্তিগত সম্পর্ককে বিচার প্রক্রিয়ায় প্রভাবিত করতে দেওয়া ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। প্রকৃত ইনসাফ তখনই প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন সত্য ও ন্যায়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়, কোনো ধরনের ব্যক্তিগত বা সামাজিক প্রভাবকে সেখানে প্রাধান্য দেওয়া হয় না।

