অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ২০ শতক পর্যন্ত নারীদের শিক্ষাগ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল
ইসলাম ও জীবন ডেস্ক
২৮ নভেম্বর ২০২২, ২১:০৮:১৭ | অনলাইন সংস্করণ
ড. মুহাম্মাদ আকরাম নদভি বর্তমান বিশ্বের একজন প্রখ্যাত মুসলিম স্কলার। ক্যামব্রিজ ইসলামিক কলেজের ডিন, আসসালাম ইন্সটিটিউটের প্রিন্সিপাল এবং মার্কফিল্ড ইন্সটিটিউট অব হায়ার এডুকেশনের অনারারি ভিজিটিং ফেলো।
১৯৮৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অক্সফোর্ড সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো ছিলেন।
তিনি মুসলিম নারী মুহাদ্দিসদের জীবনী নিয়ে ৪৩ খণ্ডে 'আল-ওয়াফা বি আসমাইন নিসা' নামক চরিত-কোষ রচনা করেছেন। যাতে প্রায় দশ হাজার নারী মুহাদ্দিসদের জীবনী স্থান পেয়েছে। এই কাজে তিনি ১৫ বছর ব্যয় করেছেন।
বাংলাদেশ সফরের অংশ হিসেবে গত ২৯ অক্টোবর ২০২২ তিনি ঢাকা বায়তুল মোকাররম ইসলামি মিলনায়তনে পুরুষদের উদ্দেশ্যে উর্দু ভাষায় বক্তব্য রাখেন। আজ ছাপা হচ্ছে তার তৃতীয় ও শেষ কিস্তি। অনুলিখন ও অনুবাদ করেছেন- মুহিম মাহফুজ।
আমার এ বক্তব্য শুনে সেখানে উপস্থিত একজন খ্রিস্টান নারী দাঁড়িয়ে বললেন, আমি আপনার বক্তব্যের সঙ্গে একমত। আমাদের খ্রিস্ট ধর্মে নারীদের অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আজকে পাশ্চাত্য সমাজ নারীদের পশ্চাদপদ করে রাখছে, নিপীড়ন করছে। এর কারণ ধর্ম নয়, গ্রীক দর্শন। গ্রীক দর্শনের কারণে আজকে পাশ্চাত্য সমাজ খ্রিষ্ট ধর্মের মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, নারী নিপীড়ন ও নারীকে পশ্চাদপদ করে রাখার পেছনে মূল দায় পাশ্চাত্য দর্শনের। কিন্তু অপবাদ দেওয়া হচ্ছে ইসলামের ওপর, ধর্মের ওপর। অথচ ইউরোপীয় দর্শনের বিরুদ্ধে আপত্তি তোলার কথা ছিল। দর্শন শাস্ত্রের দিকে আঙুল তোলার কথা ছিল।
ইউরোপের দীর্ঘ সময়ের ইতিহাসে শিক্ষিত নারীদের ইতিহাস জানা যায় না। নারীশিক্ষার সিলসিলা ইউরোপে কখনো ছিল না। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইউনিভার্সিটি। যার বয়স প্রায় ৮০০ বছর। অথচ বিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত এখানে নারীদের শিক্ষা গ্রহণের অধিকার ছিল না। আইন করে নারীদের ভর্তি নিষিদ্ধ রাখা হয়েছিল। বিশ শতকের শুরুতে নারীরা এখানে পড়াশোনার সুযোগ পায়।
ইসলাম নারীদের সম্পদের অধিকার দিয়েছে। পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা এ বিধান প্রতিষ্ঠা করেছেন। অথচ ব্রিটিশ আইনে ১৯৫০ সনের আগ পর্যন্ত সম্পত্তিতে নারীদের কোন অধিকার ছিল না। এমনকি আইনের মাধ্যমে এটা স্বীকৃত ছিল যে, বিয়ের পর নারীদের নিজের ওপর নিজের কোন অধিকার থাকবে না।
বৃটেনের সাধারণ আইনে এটা লিপিবদ্ধ না থাকলেও ব্রিটিশ সমাজে এটা প্রচলিত যে, কেউ জুয়ায় হেরে গিয়ে তার স্ত্রীকে পর্যন্ত বাজি রাখতে পারতো। অনেকেই জুয়ায় হেরে গিয়ে তার স্ত্রীর ওপর বাজি ধরতো। এটা বৃটেনের সাধারণ প্রচলনে পরিণত ছিল।
নারীদের মধ্যে রুহ বা আত্মা আছে কি নেই- এটা নিয়ে ইউরোপে কিছুদিন আগ পর্যন্ত বিতর্ক চলমান ছিল। এই বিতর্ক স্বয়ং প্রচলিত খ্রিস্টধর্মেও রয়ে গেছে। এ হলো আধুনিক উন্নত ইউরোপের অবস্থা।
ইসলামি জ্ঞান অর্জনের জন্য মানুষ এ অঞ্চলে ছুটে আসতো
প্রকৃত সত্য হলো নারীদের ওপর যে নিপীড়ন ও অত্যাচার দর্শন শাস্ত্র করেছে, খ্রিস্টধর্ম করেছে, অন্য কোন ধর্ম সেটা করেনি। মুসলিম সমাজে কোথাও কোন নিপীড়নের ঘটনা ঘটলে তার কারণ তাদের প্রভাব ও সংস্পর্শ । কেননা নারীদের অধিকার ও শিক্ষার ব্যাপারে কুরআন ও হাদিস সবসময় ইতিবাচক এবং উৎসাহী। এই প্রকৃত সত্য যখন বিশ্ববাসীর সামনে প্রকাশ পাবে, তখন প্রোপাগান্ডাকারীরা মুখ থুবড়ে পড়বে। তাদের মিথ্যার দম্ভ প্রতিহত হবে।
সেজন্য আলেম সমাজকে মনে রাখতে হবে, এ যুগের ছেলে-মেয়েরা একটি নতুন পৃথিবীতে বাস করছে। তারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি তাদের পড়ানো হচ্ছে। এসবের সংস্পর্শে তাদের মধ্যে বিচিত্র ধরনের প্রশ্ন ও সংশয় দেখা দিচ্ছে।
অনুগ্রহ করে তাদেরকে নিজের ভাই ভাবুন। নিজের সন্তান মনে করুন। মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনুন। তারা কী বলতে চায় সেটা উপলব্ধি করুন। তাদের প্রশ্নের জবাবগুলো বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় লিখে প্রকাশ করুন। যে ভাষা তারা বোঝে সে ভাষা গ্রহণ করুন। আপনাদের উত্তর যেন জ্ঞানতাত্বিক এবং যুক্তিভিত্তিক হয়। বিতর্কমূলক মানসিকতা পরিহার করতে হবে। রাগ বা বিরক্তি হজম করতে হবে।
সামান্য কোন কারণে কাউকে যেন আমরা একথা বলে না বসি, তুমি ফাসেক হয়ে গেছো। কাফের হয়ে গেছো। যদি তাদের কথায় কোন ভুল বোঝাবুঝি থাকে, সেটা সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে। ইসলামের প্রতিটি বিধি-বিধানের যৌক্তিক কারণ ও ব্যাখ্যা তাদের জানাতে হবে। এটা আমাদের আলেম সমাজের দায়িত্ব।
মানুষকে ফাসেক বলার দ্বারা, কাফের বলার দ্বারা এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। বরং এ আচরণে এটাই প্রমাণিত হবে যে, আমাদের কাছে কোন প্রমাণ নেই। দলিল নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষকে কাফের-ফাসেক বলার দ্বারা, প্রশ্নের বিপরীতে তিরস্কার করার দ্বারা তাদের খুব ক্ষতি হয়। তারা ইসলাম থেকে দূরে সরে যায়।
ভারতীয় উপমহাদেশের দীর্ঘদিনের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি, যাকে কাফের ঘোষণা করা হয়েছে, সে আরো ফুলে-ফেঁপে প্রসার লাভ করেছে। কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে আমরা কাফের ঘোষণা দিয়েছি। তাতে কি তাদের সংখ্যা কমেছে? বরং দিন দিন তাদের সংখ্যা বাড়ছে।
পাকিস্তান মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশ। তবু সেখানে ইসলামের চেয়ে দ্রুত গতিতে কাদিয়ানী ধর্ম প্রসার লাভ করছে। অথচ আমরা তো তাদের কাফের ঘোষণা করেছি। তবু তাদের এত প্রচার-প্রসারের কারণ কী? কারণ আমরা এমন পদ্ধতি গ্রহণ করেছি, যেটা নবীওয়ালা পদ্ধতি নয়। নবীরা কাউকে কাফের ঘোষণা করতো না। তারা কাফের বানানোর চেষ্টা করত না। বরং কাফেরদের মুসলমান বানানোর চেষ্টা করত।
আমাদের উচিত ছিল, কাদিয়ানীদের কাছে যাওয়া, তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করা, তাহলে হয়তো তাদের বড় একটি অংশকে আমরা মুসলমান বানাতে পারতাম।
ভারত ও বাংলা অঞ্চলে যখন ইসলামের দাওয়াত নিয়ে মুসলমানেরা আগমন করেছিলেন, তখন এ অঞ্চলের মানুষ ধর্মে হিন্দু ছিল। তারা হিন্দুদেরকে দাওয়াত দিতেন। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করতেন। ভালোবাসা বিনিময় করতেন। দাওয়াতের স্বার্থে তারা খানকা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। খানকায় হিন্দুদেরকে ডাকতেন। খাওয়াতেন। তাদের মেহমানদারী করতেন। এ আচরণ দেখে হিন্দুরা সহজে মুসলমান হয়ে গিয়েছিলো।
সংশয় নিরসন করে মানুষের হৃদয়ে ইসলামের ভালোবাসা সৃষ্টি করতে হবে
তিনি জবাব দেন, আমার একজন মুসলমান বন্ধু ছিল। সে একবার আমাকে তার ঘরে দাওয়াত দিয়েছিল। খাবারের তালিকায় ছিল বিরিয়ানি। সে বিরিয়ানি আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছিল। তারপর আমি ভাবলাম, যে ধর্মের মানুষের খাবার-রুচি এত সুন্দর, এত উন্নত, তাদের ধর্ম নিশ্চয়ই আরো সুন্দর হবে। এ কারণে আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি।
এ ঘটনা থেকে আমি বলতে চাই, আপনি যদি ভালোবেসে অমুসলিমদের বিরিয়ানি খাওয়ান, আপনার বিরিয়ানি খেয়েও তারা মুসলমান হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ঘৃণা করার দ্বারা মুসলমান হবে না। কাফের বলে গালি দেবার দ্বারা মুসলমান হবে না।
ইংল্যান্ড গেলে আপনারা দেখবেন, কী পরিমান বাঙালি এবং ভারতীয় সেখানে বসবাস করে। সেখানে অনেক বাঙালি ও ভারতীয় রেস্টুরেন্ট আছে। সেসব রেস্টুরেন্টে সুস্বাদু বিরিয়ানি রান্না করা হয়, কোরমা পোলাও রান্না করা হয়। প্রায় সব ধরনের ভারতীয় খাবার সেখানে পাওয়া যায়। সেখানে গেলে আপনি দেখবেন, রাতের বেলা সেসব রেস্টুরেন্টে ভিড় লেগে থাকে। আর তাদের অধিকাংশই থাকে ইংরেজ বা ব্রিটিশ।
আমার অনেক ভারতীয় ও বাংলাদেশী শাগরেদ আছে। আমি তাদের বলি, আপনারা বিরিয়ানি ভালোবাসেন। বিদেশে এসেও সেসব রান্না করেন। অন্যদেরকে দাওয়াত দেন। সে জন্যেই ব্রিটিশরা আপনাদের বিরিয়ানি খেতে বাধ্য হয়। আপনারা যদি নামাজের এমন স্বাদ অনুভব করতেন। যদি নামাজের দাওয়াত দিতেন। তারা নামাজও কবুল করত। আপনারা যদি এভাবে আপনাদের ধর্মের দাওয়াত দিতেন, তারা আপনাদের ধর্ম গ্রহণ করত। এজন্য আমাদের ভালোবাসা ও মোহাব্বতের প্রচার করতে হবে।
ইসলাম এমন একটি ধর্ম যা ভালোবাসা নিয়ে প্রচার করলে মানুষ কবুল করে নেয়। এ কথার ওপরই আমার আজকের বক্তব্য শেষ করছি। সকল প্রসংশা আল্লাহ তাআলার জন্য।
অনুবাদক: মুহিম মাহফুজ
শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস বিভাগ, বাগমুছা ইসলামিক সেন্টার, সোনারগাঁ, নারায়নগঞ্জ
mo.mahfuz@gmail.com
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ২০ শতক পর্যন্ত নারীদের শিক্ষাগ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল
ড. মুহাম্মাদ আকরাম নদভি বর্তমান বিশ্বের একজন প্রখ্যাত মুসলিম স্কলার। ক্যামব্রিজ ইসলামিক কলেজের ডিন, আসসালাম ইন্সটিটিউটের প্রিন্সিপাল এবং মার্কফিল্ড ইন্সটিটিউট অব হায়ার এডুকেশনের অনারারি ভিজিটিং ফেলো।
১৯৮৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অক্সফোর্ড সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো ছিলেন।
তিনি মুসলিম নারী মুহাদ্দিসদের জীবনী নিয়ে ৪৩ খণ্ডে 'আল-ওয়াফা বি আসমাইন নিসা' নামক চরিত-কোষ রচনা করেছেন। যাতে প্রায় দশ হাজার নারী মুহাদ্দিসদের জীবনী স্থান পেয়েছে। এই কাজে তিনি ১৫ বছর ব্যয় করেছেন।
বাংলাদেশ সফরের অংশ হিসেবে গত ২৯ অক্টোবর ২০২২ তিনি ঢাকা বায়তুল মোকাররম ইসলামি মিলনায়তনে পুরুষদের উদ্দেশ্যে উর্দু ভাষায় বক্তব্য রাখেন। আজ ছাপা হচ্ছে তার তৃতীয় ও শেষ কিস্তি। অনুলিখন ও অনুবাদ করেছেন- মুহিম মাহফুজ।
আমার এ বক্তব্য শুনে সেখানে উপস্থিত একজন খ্রিস্টান নারী দাঁড়িয়ে বললেন, আমি আপনার বক্তব্যের সঙ্গে একমত। আমাদের খ্রিস্ট ধর্মে নারীদের অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আজকে পাশ্চাত্য সমাজ নারীদের পশ্চাদপদ করে রাখছে, নিপীড়ন করছে। এর কারণ ধর্ম নয়, গ্রীক দর্শন। গ্রীক দর্শনের কারণে আজকে পাশ্চাত্য সমাজ খ্রিষ্ট ধর্মের মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, নারী নিপীড়ন ও নারীকে পশ্চাদপদ করে রাখার পেছনে মূল দায় পাশ্চাত্য দর্শনের। কিন্তু অপবাদ দেওয়া হচ্ছে ইসলামের ওপর, ধর্মের ওপর। অথচ ইউরোপীয় দর্শনের বিরুদ্ধে আপত্তি তোলার কথা ছিল। দর্শন শাস্ত্রের দিকে আঙুল তোলার কথা ছিল।
ইউরোপের দীর্ঘ সময়ের ইতিহাসে শিক্ষিত নারীদের ইতিহাস জানা যায় না। নারীশিক্ষার সিলসিলা ইউরোপে কখনো ছিল না। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইউনিভার্সিটি। যার বয়স প্রায় ৮০০ বছর। অথচ বিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত এখানে নারীদের শিক্ষা গ্রহণের অধিকার ছিল না। আইন করে নারীদের ভর্তি নিষিদ্ধ রাখা হয়েছিল। বিশ শতকের শুরুতে নারীরা এখানে পড়াশোনার সুযোগ পায়।
ইসলাম নারীদের সম্পদের অধিকার দিয়েছে। পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা এ বিধান প্রতিষ্ঠা করেছেন। অথচ ব্রিটিশ আইনে ১৯৫০ সনের আগ পর্যন্ত সম্পত্তিতে নারীদের কোন অধিকার ছিল না। এমনকি আইনের মাধ্যমে এটা স্বীকৃত ছিল যে, বিয়ের পর নারীদের নিজের ওপর নিজের কোন অধিকার থাকবে না।
বৃটেনের সাধারণ আইনে এটা লিপিবদ্ধ না থাকলেও ব্রিটিশ সমাজে এটা প্রচলিত যে, কেউ জুয়ায় হেরে গিয়ে তার স্ত্রীকে পর্যন্ত বাজি রাখতে পারতো। অনেকেই জুয়ায় হেরে গিয়ে তার স্ত্রীর ওপর বাজি ধরতো। এটা বৃটেনের সাধারণ প্রচলনে পরিণত ছিল।
নারীদের মধ্যে রুহ বা আত্মা আছে কি নেই- এটা নিয়ে ইউরোপে কিছুদিন আগ পর্যন্ত বিতর্ক চলমান ছিল। এই বিতর্ক স্বয়ং প্রচলিত খ্রিস্টধর্মেও রয়ে গেছে। এ হলো আধুনিক উন্নত ইউরোপের অবস্থা।
ইসলামি জ্ঞান অর্জনের জন্য মানুষ এ অঞ্চলে ছুটে আসতো
প্রকৃত সত্য হলো নারীদের ওপর যে নিপীড়ন ও অত্যাচার দর্শন শাস্ত্র করেছে, খ্রিস্টধর্ম করেছে, অন্য কোন ধর্ম সেটা করেনি। মুসলিম সমাজে কোথাও কোন নিপীড়নের ঘটনা ঘটলে তার কারণ তাদের প্রভাব ও সংস্পর্শ । কেননা নারীদের অধিকার ও শিক্ষার ব্যাপারে কুরআন ও হাদিস সবসময় ইতিবাচক এবং উৎসাহী। এই প্রকৃত সত্য যখন বিশ্ববাসীর সামনে প্রকাশ পাবে, তখন প্রোপাগান্ডাকারীরা মুখ থুবড়ে পড়বে। তাদের মিথ্যার দম্ভ প্রতিহত হবে।
সেজন্য আলেম সমাজকে মনে রাখতে হবে, এ যুগের ছেলে-মেয়েরা একটি নতুন পৃথিবীতে বাস করছে। তারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি তাদের পড়ানো হচ্ছে। এসবের সংস্পর্শে তাদের মধ্যে বিচিত্র ধরনের প্রশ্ন ও সংশয় দেখা দিচ্ছে।
অনুগ্রহ করে তাদেরকে নিজের ভাই ভাবুন। নিজের সন্তান মনে করুন। মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনুন। তারা কী বলতে চায় সেটা উপলব্ধি করুন। তাদের প্রশ্নের জবাবগুলো বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় লিখে প্রকাশ করুন। যে ভাষা তারা বোঝে সে ভাষা গ্রহণ করুন। আপনাদের উত্তর যেন জ্ঞানতাত্বিক এবং যুক্তিভিত্তিক হয়। বিতর্কমূলক মানসিকতা পরিহার করতে হবে। রাগ বা বিরক্তি হজম করতে হবে।
সামান্য কোন কারণে কাউকে যেন আমরা একথা বলে না বসি, তুমি ফাসেক হয়ে গেছো। কাফের হয়ে গেছো। যদি তাদের কথায় কোন ভুল বোঝাবুঝি থাকে, সেটা সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে। ইসলামের প্রতিটি বিধি-বিধানের যৌক্তিক কারণ ও ব্যাখ্যা তাদের জানাতে হবে। এটা আমাদের আলেম সমাজের দায়িত্ব।
মানুষকে ফাসেক বলার দ্বারা, কাফের বলার দ্বারা এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। বরং এ আচরণে এটাই প্রমাণিত হবে যে, আমাদের কাছে কোন প্রমাণ নেই। দলিল নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষকে কাফের-ফাসেক বলার দ্বারা, প্রশ্নের বিপরীতে তিরস্কার করার দ্বারা তাদের খুব ক্ষতি হয়। তারা ইসলাম থেকে দূরে সরে যায়।
ভারতীয় উপমহাদেশের দীর্ঘদিনের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি, যাকে কাফের ঘোষণা করা হয়েছে, সে আরো ফুলে-ফেঁপে প্রসার লাভ করেছে। কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে আমরা কাফের ঘোষণা দিয়েছি। তাতে কি তাদের সংখ্যা কমেছে? বরং দিন দিন তাদের সংখ্যা বাড়ছে।
পাকিস্তান মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশ। তবু সেখানে ইসলামের চেয়ে দ্রুত গতিতে কাদিয়ানী ধর্ম প্রসার লাভ করছে। অথচ আমরা তো তাদের কাফের ঘোষণা করেছি। তবু তাদের এত প্রচার-প্রসারের কারণ কী? কারণ আমরা এমন পদ্ধতি গ্রহণ করেছি, যেটা নবীওয়ালা পদ্ধতি নয়। নবীরা কাউকে কাফের ঘোষণা করতো না। তারা কাফের বানানোর চেষ্টা করত না। বরং কাফেরদের মুসলমান বানানোর চেষ্টা করত।
আমাদের উচিত ছিল, কাদিয়ানীদের কাছে যাওয়া, তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করা, তাহলে হয়তো তাদের বড় একটি অংশকে আমরা মুসলমান বানাতে পারতাম।
ভারত ও বাংলা অঞ্চলে যখন ইসলামের দাওয়াত নিয়ে মুসলমানেরা আগমন করেছিলেন, তখন এ অঞ্চলের মানুষ ধর্মে হিন্দু ছিল। তারা হিন্দুদেরকে দাওয়াত দিতেন। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করতেন। ভালোবাসা বিনিময় করতেন। দাওয়াতের স্বার্থে তারা খানকা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। খানকায় হিন্দুদেরকে ডাকতেন। খাওয়াতেন। তাদের মেহমানদারী করতেন। এ আচরণ দেখে হিন্দুরা সহজে মুসলমান হয়ে গিয়েছিলো।
সংশয় নিরসন করে মানুষের হৃদয়ে ইসলামের ভালোবাসা সৃষ্টি করতে হবে
তিনি জবাব দেন, আমার একজন মুসলমান বন্ধু ছিল। সে একবার আমাকে তার ঘরে দাওয়াত দিয়েছিল। খাবারের তালিকায় ছিল বিরিয়ানি। সে বিরিয়ানি আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছিল। তারপর আমি ভাবলাম, যে ধর্মের মানুষের খাবার-রুচি এত সুন্দর, এত উন্নত, তাদের ধর্ম নিশ্চয়ই আরো সুন্দর হবে। এ কারণে আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি।
এ ঘটনা থেকে আমি বলতে চাই, আপনি যদি ভালোবেসে অমুসলিমদের বিরিয়ানি খাওয়ান, আপনার বিরিয়ানি খেয়েও তারা মুসলমান হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ঘৃণা করার দ্বারা মুসলমান হবে না। কাফের বলে গালি দেবার দ্বারা মুসলমান হবে না।
ইংল্যান্ড গেলে আপনারা দেখবেন, কী পরিমান বাঙালি এবং ভারতীয় সেখানে বসবাস করে। সেখানে অনেক বাঙালি ও ভারতীয় রেস্টুরেন্ট আছে। সেসব রেস্টুরেন্টে সুস্বাদু বিরিয়ানি রান্না করা হয়, কোরমা পোলাও রান্না করা হয়। প্রায় সব ধরনের ভারতীয় খাবার সেখানে পাওয়া যায়। সেখানে গেলে আপনি দেখবেন, রাতের বেলা সেসব রেস্টুরেন্টে ভিড় লেগে থাকে। আর তাদের অধিকাংশই থাকে ইংরেজ বা ব্রিটিশ।
আমার অনেক ভারতীয় ও বাংলাদেশী শাগরেদ আছে। আমি তাদের বলি, আপনারা বিরিয়ানি ভালোবাসেন। বিদেশে এসেও সেসব রান্না করেন। অন্যদেরকে দাওয়াত দেন। সে জন্যেই ব্রিটিশরা আপনাদের বিরিয়ানি খেতে বাধ্য হয়। আপনারা যদি নামাজের এমন স্বাদ অনুভব করতেন। যদি নামাজের দাওয়াত দিতেন। তারা নামাজও কবুল করত। আপনারা যদি এভাবে আপনাদের ধর্মের দাওয়াত দিতেন, তারা আপনাদের ধর্ম গ্রহণ করত। এজন্য আমাদের ভালোবাসা ও মোহাব্বতের প্রচার করতে হবে।
ইসলাম এমন একটি ধর্ম যা ভালোবাসা নিয়ে প্রচার করলে মানুষ কবুল করে নেয়। এ কথার ওপরই আমার আজকের বক্তব্য শেষ করছি। সকল প্রসংশা আল্লাহ তাআলার জন্য।
অনুবাদক: মুহিম মাহফুজ
শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস বিভাগ, বাগমুছা ইসলামিক সেন্টার, সোনারগাঁ, নারায়নগঞ্জ
mo.mahfuz@gmail.com