
হ্যাঁ, আমি দারুল উলুম দেওবন্দ...! আমি কাসিমুল উলুম ওয়াল খায়েরাত মাওলানা মুহাম্মদ কাসিম নানুতুবির রোপণকৃত ছায়াদান বৃক্ষ। আমি রশিদ আহমদ গঙ্গোহির আবাস। হাজি আবিদ হোসাইনের একনিষ্ট মুজাহাদার তাজমহল। হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজির মক্কির স্বপ্নের বাস্তবতা।
মাওলানা ইয়াকুব নানুতুবির সংগ্রামের ফসল। মাওলানা জুলফিকার আলী দেওবন্দির অপূর্ব সৃষ্টিকর্ম। আশরাফ আলি থানভির জ্ঞানের ভাণ্ডার। আনোয়ার শাহ কাশ্মীরির মতো জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিসের জন্মদাতা।
শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দির স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীক। হুসাইন আহমদ মাদানির আজাদি সংগ্রামের সুতিকাগার। ক্বারি মুহাম্মদ তাইয়্যিব কাসেমির ধৈর্য ও ভারসাম্যের প্রতিচ্ছবি। আমিই দেওবন্দ..........................!
আমি সেই প্রতিষ্ঠান-যে উবায়দুল্লাহ সিন্ধিকে মুজাহিদে ইসলাম বানিয়েছে। যার দরসে বসেছেন-তাবলিগ জামাতের প্রবর্তক মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভি। যে আশ্রয় দিয়েছে মুফতিয়ে আজম কিফায়তুল্লাহ দেহলভিকে। যে পরিচয় করিয়েছে মুহাদ্দিসে জলিল খলিল আহমদ সাহারানপুরিকে। খ্যাতি দিয়েছে শব্বির আহমদ উসমানিকে। বিকশিত করেছে ইব্রাহিম বিলিয়াভিকে।
যুগের সাহিত্যিক বানিয়েছে এযায আলি আমরোহিকে। ইতিহাসবিদ বানিয়েছে মানাযির আহসান গিলানিকে। মুহাম্মদ শফি উসমানিকে মুফতিয়ে আজম পাকিস্তানের আসনে সমাসীন করেছে। সাহস দিয়েছে হিফজুর রহমান সেওহারভিকে। নেতৃত্ব দিয়েছে আল্লামা ইউসুফ বিন্নোরিকে।
মুফাক্কিরে ইসলামের রাজমুকুট পরিয়েছে আবুল হাসান আলি নদভিকে। ভাষা ও সাহিত্যে প্রভুত্ব দান করেছে ওহিদুজ্জামান কিরানভিকে। ফিদায়ে মিল্লাত বানিয়েছে আসআদ মাদানিকে। হাদিসের সম্রাট বানিয়েছে আল্লামা খুরশিদ আলম উসমানিকে। কুরআনের মুফাসসির বানিয়েছে আল্লামা নঈমকে। মহান খতিব বানিয়েছে মুহাম্মদ সালিম কাসেমিকে।
আমিই সেই প্রতিষ্ঠান যা জাতিকে মাওলানা মারগুবুর রহমান বিজনুরির মতো দরবেশ দিয়েছে। এখানেই জন্ম নিয়েছেন, ‘তারানায়ে দারুল উলূম’ এর স্রষ্টা মাওলানা রিয়াসত আলী বিজনুরি।
আমি হাজার হাজার আলেমদের হাতে দ্বীনি জ্ঞান ও মারেফতের সনদ প্রদান করে মহানবীর (সা.) বাণী ‘আমি ও আমার সাহাবিরা যে পথে আছি’ এর বাস্তব রূপ দিয়েছি। আমি আজও ‘ফিকরে ওলিউল্লাহি’ (শাহ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারা) ধারায় অবিচল আছি।
আমার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল ১৮৫৭ সালের ব্যর্থ স্বাধীনতা আন্দোলনের পর, যখন ব্রিটিশরা ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজাতে চেয়েছিল যাতে জন্ম হোক এমন একটি জাতি যারা রঙ ও গঠনে ভারতীয় হলেও চিন্তাচেতনায় পুরোপুরি খ্রিস্টান হবে। সেই প্রেক্ষাপটে ১৮৬৬ সালের ৩০ মে, কাসিম নানুতুবি, হাজি আবিদ হুসাইনসহ আরও কয়েকজন সাথী মিলে একটি আনার গাছের নিচে, মসজিদে ছাত্তার প্রাঙ্গণে, আমার ভিত্তি স্থাপন করেন। যাতে জন্ম নেয় এমন একটি জাতি যারা রঙে-গঠনে ভারতীয় হলেও চিন্তায়-কর্মে খাঁটি মুসলিম হবে।
আমার জন্ম শুধুমাত্র ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থার প্রচার নয়, বরং স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য একটি সাহসী প্রজন্ম প্রস্তুত করা ছিল আমার উদ্দেশ্য। ফলে ‘রেশমি রুমাল আন্দোলন’ সূচিত হয়। যদিও তা ব্যর্থ হয়, তবুও স্বাধীনতার সংগ্রাম থামেনি। পরবর্তীতে ভারত স্বাধীন হয়, কিন্তু সঙ্গে ঘটে দেশভাগের হৃদয়বিদারক ঘটনা।
স্বাধীনতার পর, আমাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। তবে আমি সাহস হারাইনি, কাঁপিনি, দমিনি। বরং নির্ভয়ে ভারতীয় মুসলমানদের পথনির্দেশ করে গেছি।
হ্যাঁ, আমি সেই দারুল উলুম দেওবন্দ, যার প্রশংসায় কবি মাওলানা রিয়াসত আলী বিজনুরি বলেছিলেন:
"خود ساقی کوثر نے رکھی میخانے کی بنیاد یہاں،
تاریخ مرتب کرتی ہے دیوانوں کی روداد یہاں"
‘স্বয়ং জান্নাতের সাকী (হযরত মুহাম্মদ সা.) এখানে মেহখানার (জ্ঞানমন্দিরের) ভিত্তি স্থাপন করেছেন,
ইতিহাস এখানে প্রেমমুগ্ধ (আশেক) মানুষের কাহিনি লিপিবদ্ধ করে।’
হ্যাঁ, আমি সেই প্রতিষ্ঠান, যার আলোয় আলোকিত হয় পৃথিবী। যে প্রতিষ্ঠান সব সময় ‘কালাল্লাহ ও কালার রাসূল’ ধ্বনিতে মুখর থাকে। যার পাঠশালায় শুধুই ইসলামি জ্ঞান নয়, দেশপ্রেমও শেখানো হয়।
শেখানো হয়- নেতৃত্বের কৌশল, ন্যায়ের সংগ্রাম, পারস্পরিক সাম্য, সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা ও মানবসেবা।
আমি সেই দারুল উলুম দেওবন্দ, যে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে। যে প্রথম সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী সম্মেলন করে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই।
আমাকে বারবার কলঙ্কিত করার চেষ্টা হয়েছে, আমাকে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়াতে চাওয়া হয়েছে, আমাকে বন্ধ করার চক্রান্ত হয়েছে তবুও আমি থামিনি, আমার মিশনে দৃঢ় থেকেছি।
আজও আমি সেই আদর্শ নিয়ে বেঁচে আছি। বেঁচে আছি ওয়ালি উল্লাহি চেতনা নিয়ে। আমার অগ্রজদের আদর্শে আজও চলছি। আজও আমার সন্তানরা কেউ মুফতি আবুল কাসিম নোমানি, কেউ মাওলানা আরশাদ মাদানি, কেউ মাহমুদ মাদানি, কেউ মুফতি সালমান মনসুরপুরি, কেউ মাওলানা আব্দুল খালিক মাদ্রাজী, কেউ আল্লামা নিয়ামতুল্লাহ আযমি, কেউ মাওলানা শওকত আলী বস্তভি। হ্যাঁ, আমিই দারুল উলুম দেওবন্দ...
একটি উর্দূ প্রবন্ধের অনুকরণে লিখিত