Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসন কর্মসূচির রূপরেখা

Icon

ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসন কর্মসূচির রূপরেখা

দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১১ জেলায় প্রাণঘাতী বন্যায় মানুষের জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। গোটা দেশের মানুষ বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসন নিয়ে চিন্তিত। প্রতি বছর বন্যার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেও এবারের বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি।

ইতোমধ্যে বন্যাদুর্গত এলাকার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীরা তাদের একদিনের বেতন অথবা সমপরিমাণ অর্থ প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে দিয়েছে অথবা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বিদেশে কর্মরত বিভিন্ন পেশার মানুষও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বন্যার্তদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোও বন্যার্তদের পাশে রয়েছেন। যদিও ত্রাণের স্বল্পতা ও বিতরণের বিষয়ে অনেক ধরনের অভিযোগ রয়েছে। তবুও বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের মতো বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য একত্র হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো উদ্যোগ। যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় এ ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকা উচিত।

এবারের বন্যায় ৬০ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০ লাখেরও বেশি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ জীবনযাপন করছে। এ বন্যায় অন্তত ৬৭ জন মানুষ মারা গেছে। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষগুলো প্রতিনিয়ত সামান্য মাথাগোঁজার ঠাঁই খুঁজে বেড়াচ্ছেন। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে স্কুল, কলেজ, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, কৃষি ফসল, মৎস্য, পশু ও মুরগির খামার। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি জীবনযাপন করেছে, যদিও পানি কমে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে।

আশা করা যাচ্ছে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এ এলাকাগুলোয় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে অগ্রসর হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক শিশু তাদের পরিবারের সবাইকে হারিয়ে এতিম হয়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় শিশুদের জন্য বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের স্বল্পতাও দেখা দিয়েছে। যদিও ইউনিসেফের দাবি, তারা এ পর্যন্ত ১ লাখ ৩০ হাজার শিশুসহ ৩ লাখ ৩৮ হাজার মানুষকে জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন উপকরণ, যেমন-পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, পানি ধরে রাখার জন্য ক্যান ও খাবার স্যালাইন বিতরণ করেছেন। মোটা দাগে বলা যায়, সাধারণ মানুষের পাশাপাশি শিশুরাও জলবায়ু ঝুঁকিতে রয়েছে।

বন্যায় ফেনী জেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এ জেলার ছয়টি উপজেলায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে প্রায় ৯১৫ কোটি টাকার ক্ষতি দেখা দিয়েছে। তাছাড়া ৪৫১ কোটি ২০ লাখ টাকার ফসল বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। প্রায় ২ লাখ কৃষক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে জানা যায়, প্রায় ৩০ হাজার ৩৫২ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা মোট ফসলি জমির প্রায় ৮০ শতাংশ।

তন্মধ্যে ১ হাজার ৮৬৫ হেক্টর আমন ধানের বীজতলা, ২৬ হাজার হেক্টর রোপণকৃত আমন ধানের চারা, ১ হাজার ৮৫৪ হেক্টর আউশ, ৫২৫ হেক্টর সবজি, ৬৯ হেক্টর ফলবাগান, ৭ হেক্টর আদা, ১৬ হেক্টর হলুদ এবং ১৬ হেক্টর আখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাছাড়া ফেনী জেলায় ৩৮ হাজার ৭৩১টি গরু, ৩৫৯টি মহিষ, ১৫ হাজার ৫৮৮টি ছাগল ও ৭৩৬টি ভেড়া মারা গেছে। এছাড়াও ২১ লাখ ৬৭ হাজার ৫১০টি মুরগি, ১ লাখ ৮৯ হাজার ৪৭২টি হাঁস মারা গেছে। সংবাদমাধ্যমে আরও জানা যায়, ৯৫০ টন পশুপাখির দানাদার খাবারও বিনষ্ট হয়েছে।

সাধারণত জলবায়ু পরিবর্তনে অতিবৃষ্টিতে বন্যার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। ভয়াবহ বন্যায় ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে, যদিও সাধারণ বন্যা ফসল উৎপাদনের জন্য উপকারী। ভবিষ্যতে এবারের মতো বন্যার পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা নাকচ করে দেওয়া যায় না। যদি প্রতি বছর ২০২৪ সালের মতো ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়, তাহলে বন্যা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি পুনর্বাসন অতীব জরুরি।

সেক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন কমানোর পাশাপাশি দেশে বিদ্যমান নদীগুলোর নাব্য বৃদ্ধি জরুরি। তাছাড়া বন্যা-পরবর্তী সময়ে নদীতে বিদ্যমান পলি কৃষিজমিতে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে একদিকে নদীর নাব্য বাড়বে, অন্যদিকে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পাবে, যা ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

ধরা যাক, এ বছরের বন্যা আমাদের দিয়ে গেছে অভিশাপ। ভবিষ্যতে কীভাবে বন্যাকে আশীর্বাদে পরিণত করা যায়, সেই বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সেই লক্ষ্যে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসন অতীব জরুরি। মোটা দাগে বলা যেতে পারে, বন্যা মানুষের বাস্তুভিটা, স্বাস্থ্য, কৃষি, পশু, মৎস্যসম্পদ, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কলকারখানার ক্ষতি করেছে।

ইতোমধ্যে বন্যায় কৃষিতে ক্ষতির পরিমাণ জানা গেছে। তাছাড়া বন্যাদুর্গত এলাকায় পুনর্বাসনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে কর্মরত কর্মকর্তারা নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন। সরকারি নির্দেশনায় শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ধানের বীজতলা তৈরি করছে। অনেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে বন্যাদুর্গত এলাকার জন্য ধানের বীজতলা তৈরি করছে।

কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, আগস্টের শেষে এবং সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমন ধানের বীজতলা তৈরি করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান মনে করেন, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্যাকবলিত এলাকায় আলোকসংবেদনশীল বিআর ২২, ২৩ ব্রি ধান ৩৪, ৪৬, নাজিরশাইল ও অন্যান্য স্থানীয় জাতের ধানের আবাদ করা যেতে পারে।

তাছাড়া তিনি আরও মনে করেন, এ মুহূর্তে স্বল্পজীবনকালীন ব্রি ধান ৭৫ জাতটি নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন্যাদুর্গত এলাকায় চাষাবাদ করা যেতে পারে। ধানের বীজতলা তৈরি ও চাষাবাদে ব্রিতে কর্মরত বিজ্ঞানীরা বন্যাদুর্গত এলাকায় কাজ করে যাচ্ছেন। ওই বীজতলায় উৎপাদিত বিআর ২২ ধানের চারা আগামী ৬ অক্টোবরের মধ্যে রোপণ করলে ভালো ফলন পাওয়া যেতে পারে।

অন্যদিকে বন্যাকবলিত এলাকায় সবজি উৎপাদনও অব্যাহত রাখতে হবে। যেহেতু বর্ষাকালীন সবজি উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে, সেহেতু শীতকালীন সবজি উৎপাদনের দিকে নজর দিতে হবে। আগাম শীতকালীন অথবা সারা বছর উৎপাদন করা যায় এমন জাতের সবজি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। সেই লক্ষ্যে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি কুমড়া, শিম, টমেটো, চালকুমড়া, লাউ, শসা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, মরিচ ও অন্যান্য বীজ কৃষকের মধ্যে সরবরাহ করা যেতে পারে।

তাছাড়া বন্যায় ফল ও কাঠ জাতীয় গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সরকারি-বেসরকারিভাবে কৃষকের মধ্যে গাছের চারা সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। যেহেতু কৃষক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেহেতু বিনামূল্যে কৃষকের জন্য ধান, সবজি বীজ, কাঠ ও ফলজাতীয় গাছের চারা সরবরাহ অতীব জরুরি। অন্যদিকে গবাদিপশু ও মৎস্য খামার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আবারও খামার স্থাপনে কৃষককে বিনাসুদে অর্থ প্রদান করে যেতে পারে। ফলে কৃষক আবারও তাদের খামারে মৎস্য ও পশুসম্পদ উৎপাদন অব্যাহত রাখতে সক্ষম হবে, যা আমিষ ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখবে।

বন্যাদুর্গত এলাকায় ঘরবাড়ি, মসজিদ, মাদ্রাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট ও অন্যান্য স্থাপনা অতিদ্রুত মেরামতের নিমিত্তে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া বন্যাদুর্গত এলাকায় শিশু ও বয়স্ক মানুষের সুচিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মসূচি গ্রহণ করা অতীব জরুরি। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকেও কাজে লাগানো যেতে পারে।

বন্যাদুর্গত এলাকায় বন্যা-পরবর্তী কমপক্ষে এক মাস সব ধরনের প্রয়োজনীয় সাহায্য অব্যাহত রাখা উচিত। সরকারি পর্যায় ছাড়াও আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি ও ক্ষুদ্রঋণ, গাছের চারা, কৃষি উপকরণ ও সার বিতরণে প্রয়োজনীয় সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায় বিদ্যমান কর্মসূচি সংকুচিত করে বন্যাদুর্গত এলাকায় সব ধরনের সাহায্য বাড়ানো যেতে পারে। সরকারি পর্যায়ে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি ও অন্যান্য প্রকল্পের কাজ বন্যাদুর্গত এলাকায় ব্যাপক হারে চালু রাখা যেতে পারে। তাছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোক্তারাও বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।

পরিশেষে বলা যেতে পারে, বন্যা নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ যতটা, বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসন কর্মসূচিও ততটা গুরুত্বপূর্ণ। বন্যা কখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সুতরাং, বন্যাদুর্গত এলাকায় বন্যার পানি চলে যাওয়ার পরবর্তী সময়ে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে সব ধরনের প্রয়োজনীয় পুনর্বাসন কর্মসূচি গ্রহণ অতীব জরুরি। নতুবা বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।

ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম : অধ্যাপক, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

mohammad.alam@wsu.edu

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম