উন্নয়ন ও বহুমাত্রিক গবেষণা একটি অন্যটির পরিপূরক
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম
প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সুনির্দিষ্ট বিষয়ে গবেষণালব্ধ ফলাফল পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণসাপেক্ষে নিবন্ধ প্রকাশকরণই ‘রিভিউ আর্টিক্যাল’ নামে পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকরা নিজস্ব ল্যাবে গবেষণার পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করে যাচ্ছেন। তাছাড়া বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানেও গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। আবার এ গবেষণালব্ধ ফলাফলই পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। যদি গবেষকরা কোনো ভুল ফলাফল জার্নালে প্রকাশ করে থাকে, তাহলে বিশ্বের সমগ্র জাতির বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাটিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সুতরাং, গবেষণায় নৈতিকতার গুরুত্ব অপরিসীম। তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, নির্দিষ্ট এরিয়ায় শত শত গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রকাশিত হচ্ছে। যখন ওই গবেষণালব্ধ ফলাফলের ওপর পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনায় রিভিউ আর্টিক্যাল প্রকাশিত হয়, তখন গবেষণার গুণমানের পার্থক্য অতি সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়। মোটা দাগে বলা যেতে পারে, রিভিউ আর্টিক্যাল গবেষকদের গবেষণার সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারে।
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রভাষক থেকে অধ্যাপক পর্যন্ত সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয়। এ নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি ও অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। যদি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি থাকে, তাহলে অভিজ্ঞতা শিথিলযোগ্য হতে পারে। শধু কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একজন শিক্ষক কিছুটা গবেষণার অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রভাষক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হচ্ছেন। ল্যাটারাল অ্যান্ট্রিতে গবেষণা ও শিক্ষকতা উভয় অভিজ্ঞতাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। এখনো বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বহু শিক্ষক পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া শিক্ষকতা ও গবেষণা পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। অথচ উন্নত দেশে বহু গ্র্যাজুয়েট রয়েছেন, যাদের পিএইচডি ডিগ্রি থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করতে আগ্রহী নন। ওইসব দেশে গবেষণা ও শিক্ষকতার মতো পবিত্র পেশায় শুধু যোগ্য ব্যক্তিরাই বেশি আগ্রহী হন।
রিভিউ আর্টিক্যাল লিখতে হলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষণায় অভিজ্ঞতার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রশ্ন হলো, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষণার অভিজ্ঞতা কীভাবে অর্জন করা সম্ভব? একমাত্র পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষকই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরিপূর্ণ গবেষণার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন। একজন ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের পর যদি ওই বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন, তাহলে ওই ব্যক্তিই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রিভিউ আর্টিক্যাল লেখার মাধ্যমে নিজের গবেষণার অভিজ্ঞতাকে বহির্বিশ্বে ছাড়িয়ে দিতে পারে। সুতরাং, রিভিউ আর্টিক্যাল প্রকাশনায় পিএইচডি ডিগ্রির গুরুত্ব অপরিসীম। পর্যালোচনায় আরও দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রিসহ সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য কমপক্ষে একটি রিভিউ আর্টিক্যাল প্রকাশনার বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত। ওই রিভিউ আর্টিক্যালটি প্রথম অথবা করেসপন্ডিং লেখক হিসাবে প্রকাশ করা উচিত। নতুবা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যাপক পদে পদোন্নতিতে আপত্তি রাখা যেতে পারে। প্রশ্ন হলো, রিভিউ আর্টিক্যাল লেখার গুরুত্ব কেন দেওয়া উচিত? একজন শিক্ষক পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনে গবেষক হিসাবে দেশে ও বিদেশে পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হন। তাছাড়া তিনি যে বিষয়ে গবেষণা করেন, সেই বিষয়ে ব্যাপক অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত হন। ওই গবেষণা অভিজ্ঞতার প্রখরতা বৃদ্ধির জন্য রিভিউ আর্টিক্যাল লেখার গুরুত্ব রয়েছে। রিভিউ আর্টিক্যাল লেখার সময় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রকাশিত সব গবেষণা আর্টিক্যাল পড়তে হয়। নতুবা রিভিউ আর্টিক্যাল লেখা কখনো সম্ভব নয়। একজন গবেষক যখন অনেক গবেষণা আর্টিক্যাল একত্রে পড়বেন, তখন ওই বিষয়ে তিনি ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করতেও সক্ষম হবেন। শুধু তাই নয়, ওই রিভিউ আর্টিক্যালে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রকাশিত অনেক প্রযুক্তির মধ্য থেকে সবচেয়ে উত্তম প্রযুক্তির পক্ষে অবস্থান নেওয়ারও সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া ভবিষ্যতে ওই বিষয়ে যারা গবেষণা করবেন, তারা প্রকাশিত উত্তম প্রযুক্তিকে বেস্লাইন হিসাবে ধরে গবেষণার মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারবেন।
যা হোক, রিভিউ আর্টিক্যাল বিজ্ঞানী ও গবেষকদের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর ও সাইটেশন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে। একজন গবেষকের সাইটেশন যত বেশি হবে, সমগ্র বিশ্বে গবেষণায় তার পরিচিতি তত বেশি হবে। ওই বিষয়ে পৃথিবীর বিখ্যাত গবেষকদের সঙ্গে অতি সহজেই পরিচিতি অর্জনে সক্ষম হবে। ফলে নতুন নতুন গবেষণার দ্বারও উন্মোচিত হবে। উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কোলাবোরেশনও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিংয়ে, সাইটেশন ও ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকের মোট সাইটেশন যত বেশি হবে, সেই বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ে তত বেশি এগিয়ে যাবে। ফলে গবেষণালব্ধ ফলাফলের সাইটেশনই বিশ্ববিদ্যালয়কে র্যাংকিংয়ে সহায়তা করে থাকে। ওই সাইটেশন বৃদ্ধিতে রিভিউ আর্টিক্যাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সুতরাং, প্রতিটি শিক্ষকের ডিগ্রি অর্জনের পরবর্তী সময় গবেষণার পাশাপাশি রিভিউ আর্টিক্যাল লেখার বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত। রিভিউ আর্টিক্যাল গবেষকদের চলমান নতুন গবেষণাকে আপডেট করতে সাহায্য করে থাকে। রিভিউ আর্টিক্যাল পরবর্তী প্রজন্মের জন্য গবেষণায় ইতিবাচক প্রভাব রাখতেও সক্ষম।
তথ্য ও উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, রিভিউ আর্টিক্যাল একজন গবেষকের ক্রিটিক্যাল শক্তি বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, একজন গবেষক রিভিউ আর্টিক্যাল লেখার সময় প্রকাশিত গবেষণালব্ধ ফলাফলের ওপর সমালোচনা করার কৌশল ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সক্ষম হন, যা বিজ্ঞানী ও গবেষকদের চিন্তাশক্তিকে প্রসারিত করে থাকে। সুতরাং, বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকে ত্বরান্বিতকরণে রিভিউ আর্টিক্যালের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নতুন গবেষণার দ্বার উন্মোচনেও রিভিউ আর্টিক্যাল অবদান রাখতে পারে। সেই লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদেরও গবেষণা আর্টিক্যালের পাশাপাশি রিভিউ আর্টিক্যাল প্রকাশনার বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত। রিভিউ আর্টিক্যাল গবেষণার অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং, কোলাবোরেশন, গবেষণা প্রকল্প, চলমান গবেষণার সংশোধন, সাইটেশন, ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষণার পরিধি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।
একজন গবেষক রিভিউ আর্টিক্যালের মাধ্যমে নিজের দক্ষতারও বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিসম্পন্ন দক্ষ গবেষকদের রিভিউ আর্টিক্যাল লেখার বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত। একজন অধ্যাপক পিএইচডি শিক্ষার্থীর তত্ত্বাবধায়ন করা অবস্থায় রিভিউ আর্টিক্যালের সাহায্য নিতে পারে। ফলে চলমান গবেষণার পরীক্ষণ পদ্ধতির কোনো অংশে ভুল থাকলে তা অতি সহজে সংশোধন করে নিতে পারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহ্ আলম সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর নিয়মিত রিভিউ আর্টিক্যাল লিখে যাচ্ছেন। তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় নৈতিকতার গুরুত্ব অনেক বেশি। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি গবেষণা অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, সেহেতু রিভিউ আর্টিক্যাল, গবেষণার মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যেতে পারে। তিনি আরও মনে করেন, প্রকাশিত রিভিউ আর্টিক্যাল গবেষকদের চলমান গবেষণায় স্মার্টের ছোঁয়া লাগাতে সাহায্য করতে পারে। অন্যদিকে আমেরিকার ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. লিন কার্পেন্টার বগ্স মনে করেন, গবেষণা চলমান অবস্থায় প্রতিটি গবেষকের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রিভিউ আর্টিক্যাল পড়া উচিত। ফলে চলমান গবেষণাটি নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের দিকে মোড় নিতে পারে।
দেশে কোনো কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতিতে রিভিউ আর্টিক্যালকে নিরুৎসাহিত করা হয়। যদিও গবেষণালব্ধ ফলাফল ছাড়া রিভিউ আর্টিক্যাল লেখা অসম্ভব। এক কথায় রিভিউ আর্টিক্যাল হলো বহু গবেষণালব্ধ ফলাফলের মিলনমেলা। একজন গবেষক যদি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষ না হয়, সে কখনো রিভিউ আর্টিক্যাল লিখতে পারবে না। মোটা দাগে বলা যেতে পারে, রিভিউ আর্টিক্যাল গবেষণার গতি বৃদ্ধি, দক্ষতা বৃদ্ধি, নতুন গবেষণার দ্বার উন্মোচন ও একই বিষয়ে একত্রে অনেক গবেষণার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে। সুতরাং, রিভিউ আর্টিক্যালের গুরুত্ব গবেষণা আর্টিক্যালের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট গবেষকের গুরুত্ব অপরিসীম। একজন স্মার্ট গবেষকই দক্ষ জনশক্তি, দক্ষ অর্থনীতি, উন্নত সামাজিকব্যবস্থা ও স্মার্ট সরকার গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। মোটা দাগে বলা যেতে পারে, রিভিউ আর্টিক্যাল প্রকাশনা হলো একজন স্মার্ট গবেষকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পরিশেষে বলা যেতে পারে, রিভিউ আর্টিক্যাল প্রকাশনায় একটি দেশকে উন্নত ও স্মার্ট রাষ্ট্রে পরিণত করা সম্ভব।
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম : অধ্যাপক, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
mohammad.alam@wsu.edu