Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

চব্বিশের অভ্যুত্থান : বৈষম্য ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জাগরণ

Icon

ড. মাহরুফ চৌধুরী

প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চব্বিশের অভ্যুত্থান : বৈষম্য ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জাগরণ

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শুধু একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার ফল নয়, বরং এটি ছিল দীর্ঘকাল ধরে সমাজে জমে ওঠা বঞ্চনা, বৈষম্য ও স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে এক বিশাল গণজাগরণের বিস্ফোরণ। এ সময় দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণ, নগর থেকে গ্রাম পর্যন্ত হাজার হাজার তরুণ-তরুণী, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক, পেশাজীবী এবং সাধারণ মানুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল প্রতিবাদের স্লোগান, চোখে-মুখে ছিল নিপীড়নের বিরুদ্ধে জেদি প্রত্যয়, আর হৃদয়ে বহমান ছিল একটি ন্যায়ের সমাজের স্বপ্ন-একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা।

এ আন্দোলনের মর্মমূলে নিহিত ছিল দুটি শব্দ: ‘বৈষম্যহীন’ ও ‘স্বৈরাচারমুক্ত’। শব্দ দুটো নিছক স্লোগানের শব্দ ছিল না, বরং তার পেছনে ছিল দশকের পর দশক ধরে সঞ্চিত এক নিঃশব্দ আর্তনাদ, যা এ প্রজন্মের মুখে এসে উচ্চারিত হলো বিদ্রোহের ভাষায়। এ দ্বৈত দাবির মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছে সেই জনমানস, যাদের প্রাত্যহিক জীবনের বাস্তবতা হয়ে উঠেছিল বৈষম্যমূলক অর্থনীতি, রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং ন্যায়বিচারহীন রাষ্ট্রব্যবস্থার নির্মমতার শিকার হওয়া। চিন্তাবিদ ফ্রান্ৎস ফ্যাননের ভাষায়, ‘যখন উপনিবেশ বা দমনমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা একটি জনগোষ্ঠীর আশা ও স্বপ্নকে দাবিয়ে রাখে, তখন সেই জনগোষ্ঠী বিদ্রোহকেই জীবনের স্বাভাবিক পথ হিসাবে বেছে নেয়।’ চব্বিশের বাংলাদেশ যেন সেই ফ্যাননীয় বাস্তবতারই প্রতিফলন।

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গণ-আন্দোলনকে প্রায়ই রাজনৈতিক পুনর্জাগরণের সূচক হিসাবে দেখা হয়। এ প্রেক্ষাপটে, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান ছিল এক প্রকার নৈতিক প্রতিরোধ, যা শুধুই ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ছিল না, বরং তা ছিল একটি নতুন ধরনের সমাজ গঠনের স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমবেত আকাঙ্ক্ষা। এ গণ-অভ্যুত্থান প্রশ্ন তোলে পূর্ববর্তী শাসকদের বৈধতা নিয়ে, তেমনি নতুন ভবিষ্যতের প্রতি দায়বদ্ধতাও সৃষ্টি করে। এ আন্দোলন তাই শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনাই ছিল না; এটি ছিল একটি সমাজ-সাংস্কৃতিক গতিধারার নতুন বাঁক, যেখানে একটি নতুন প্রজন্ম তার অতীতের সব ব্যর্থতার দায়ভার ঝেড়ে ফেলে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মমর্যাদার দাবিতে আত্মপ্রকাশ করে। এটি ছিল ইতিহাসের সেই ক্ষণ, যখন বহু শোষিত, নিঃস্ব ও অপদস্ত মানুষ একযোগে বলেছিল, ‘আর নয়, যথেষ্ট হয়েছে’।

বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রথম দৃশ্যমান প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছিলেন এ আন্দোলনের সূচক ও চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রায়ই ছাত্রসমাজই প্রথম আওয়াজ তোলে। যেমনটি আমরা দেখেছি ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে কিংবা ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। ২০২৪-এর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু এ আন্দোলনের ভিত্তিভূমি ছিল পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় অনেক বেশি জটিল ও বহুমাত্রিক। এটি শুধু ধনী-দরিদ্রের আর্থিক ব্যবধানের প্রশ্ন ছিল না; বরং এর গভীরে ছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাঠামো শক্তির অপব্যবহার ও রাজনৈতিক আনুগত্যকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বৈষম্য, যা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মানবিক মর্যাদাকে প্রতিনিয়ত আঘাত করছিল।

সরকারি চাকরিতে দলীয়করণ, উচ্চশিক্ষায় রাজনৈতিক আনুগত্যকে প্রাধান্য দেওয়া, কোটাব্যবস্থার নামে একপাক্ষিক সুবিধাবণ্টন এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকারকে অবহেলা করার মাধ্যমে তৈরি হচ্ছিল একটি পক্ষপাতদুষ্ট ও অনৈতিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব থাকা স্বাভাবিক হলেও যখন সেই দায়িত্ব কৃতজ্ঞতার গণ্ডি পেরিয়ে একচোখা সুযোগসন্ধানী ব্যবস্থায় পরিণত হয়, তখন সেটি বৈষম্যের রূপ পরিগ্রহ করে। আন্দোলনকারীদের মধ্যে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিল: যদি রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক সমান মর্যাদার অধিকারী হয়, তবে কেন জন্মপরিচয়, রাজনৈতিক পরিচয় কিংবা সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী তার শিক্ষার অধিকার বা চাকরির সুযোগ নির্ধারিত হবে? ছাত্রদের ন্যায্য দাবিকে উপেক্ষা করে সরকার যখন কঠোর ও দমনমূলক অবস্থান নেয়, তখন আন্দোলন একটি নতুন মোড় নেয়। এটি হয়ে ওঠে কেবল একটি দাবি-দাওয়ানির্ভর প্রতিবাদ নয়, বরং এক স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণের সুতীব্র প্রতিরোধ।

তরুণদের প্রতিরোধে ফুটে উঠেছিল প্রতীকী ও সাংস্কৃতিক প্রতিবাদের এক নতুন ভাষা। কখনো তা ছিল দেওয়ালে আঁকা ছায়াময় কবিতায়, কখনো তা ছিল হাত লেখা পোস্টারে, কখনো বা নিঃশব্দ প্লাকার্ডে লেখা একটিমাত্র বাক্যে ধরা পড়ত গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের গণবিচ্ছিন্ন অপ্রত্যাশিত মূর্তি। এসব অভিব্যক্তি ছিল সরাসরি রাষ্ট্রের ছায়াতলে শাসক শ্রেণির দমননীতি ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে এক সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের অস্ত্র। আন্দোলনকারীদের অবস্থান ছিল সুস্পষ্ট, তারা কোনো আপসে বিশ্বাস করেনি। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে নবপ্রজন্ম যে আত্মদায়বদ্ধতার পরিচয় দিয়েছে, তা নিছক নৈতিক অবস্থান নয়, বরং ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে এসে রক্তাক্ত প্রতিরোধের মাধ্যমে তারা ভবিষ্যতের পথচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। চব্বিশের আন্দোলন তাই কেবল একটি রাজনৈতিক মোড় নয়, এটি ছিল এক জনজাগরণ, যা তরুণদের বিবেক ও চেতনার গভীরতম স্তর থেকে উৎসারিত। নতুন প্রজন্মের এ জাগরণ শুধু রাজনৈতিক সচেতনতার ফল নয়; এটি এক গভীর নৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের প্রতিফলন। ইতালীয় চিন্তাবিদ আন্তোনিও গ্রামশি যেমন ‘জৈবিক বুদ্ধিজীবী’ (অর্গানিক ইন্টালেকচুয়ালস)-এর কথা বলেন, যারা সমাজের ভেতর থেকে উঠে এসে বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, সেই অর্থে বাংলাদেশের এ তরুণরা এখন আর কেবল সুবিধাভোগী শ্রেণির মুখপাত্র নয়, বরং হয়ে উঠেছে সমাজ-রূপান্তরের চেতনাপ্রসূত প্রজ্ঞার বাহক। তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে এক বিকাশমান সাংস্কৃতিক বোধ, যা শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা নয়, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা-চর্চা এবং ভাষার ভেতরেও পরিবর্তন ঘটাতে চায়। তারা কেবল ‘পরিবর্তনের দাবি’ করছে না; বরং নিজেদের চিন্তা-চর্চা, আচরণ এবং প্রতিদিনের জীবনের ভেতরে সেই পরিবর্তনের বীজ রোপণ করছে। এ নৈতিক জাগরণ তাই কেবল স্বৈরাচারবিরোধী রাজনৈতিক প্রতিবাদ নয়, এটি এক সামাজিক নবজাগরণ, যা ব্যক্তি-মানসে মুক্তির সম্ভাবনা তৈরি করছে।

রাষ্ট্র, সমাজ এবং শিক্ষা-জাতীয় জীবনের এ তিনটি স্তম্ভের সম্মিলিত দায়বদ্ধতার মধ্য দিয়েই এ আন্দোলনের চেতনা স্থায়ী রূপ পেতে পারে। আজ যখন আমরা আবার নানা ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক দমননীতি, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ এবং বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মুখোমুখি হচ্ছি, তখন সবচেয়ে জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে এ আন্দোলনের শিক্ষা ও প্রেরণাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত করা। সমাজ বদলের দায়িত্ব কিছু নির্বাচিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নয়; এটি আমাদের সবার, বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণদের, যাদের কণ্ঠে ভবিষ্যতের স্বর ধ্বনিত হয়। তাদের প্রয়োজন আত্মসমালোচনার চোখে নিজেদের কর্মকাণ্ডকে দেখার, নৈতিক উপলব্ধিকে কাজে লাগানোর এবং যেখানেই অন্যায়-অবিচার দেখা যায়, সেখানে নির্ভয়ে, দৃঢ়তায় ও মানবিক দায়িত্বে রুখে দাঁড়ানোর। কারণ সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোই একটি বিবেকবান প্রজন্মের প্রথম এবং অপরিহার্য দায়িত্ব। সময় নীরব অথচ নিরপেক্ষ বিচারক হয়ে প্রতিবার ফিরে এসে আমাদের সামনে রাখে কিছু অবিরাম প্রশ্ন: কে ছিল অন্যায়ের পাশে, আর কে ন্যায়ের পক্ষে সাহস করে দাঁড়াতে পেরেছিল? এ প্রশ্নের উত্তর শুধু ইতিহাসবিদ বা রাজনৈতিক বিশ্লেষকের নয়, এটি প্রতিটি নাগরিকের, প্রতিটি তরুণের, প্রতিটি শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী ও চিন্তাশীল মানুষের। আমাদের প্রত্যেককে এ প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। কারণ ইতিহাসের সবচেয়ে জরুরি অধ্যায়গুলো কখনো কেবল যুদ্ধে লেখা হয়নি, বরং লেখা হয়েছে মানুষের বিবেকের দীপ্তিতে।

যাদের হৃদয়ে এখনো সামান্য হলেও সাহস আছে, ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা আছে, সাম্যের প্রতি বিশ্বাস আছে-তাদের কেউই এ প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে পারে না। আলবেয়ার কামুর ভাষায়, ‘একটি শৃঙ্খলিত বিশ্বের সাথে মোকাবিলা করার একমাত্র উপায় হল এতটাই সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়া যে তোমার অস্তিত্বই বিদ্রোহের ঘটনার মতো হয়ে উঠবে’। চব্বিশের চেতনা আমাদের সেই স্বাধীন সত্তা হয়ে ওঠারই ডাক দেয়। আজ যখন আমরা ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের কথা স্মরণ করি, তখন এ স্মরণ যেন কেবল একটি অতীত অধ্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন নয়, বরং সঙ্গে সঙ্গে হয়ে উঠুক ভবিষ্যতের প্রতি এক দৃপ্ত অঙ্গীকার। এ স্মৃতি হোক আমাদের বিবেকের জাগরণ, চেতনার দীপ্তি এবং সামষ্টিক ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়ার পাথেয়।

ড. মাহরুফ চৌধুরী : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য।

Email: mahruf@ymail.com

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম