হাসিনার অপকর্ম : একটি বিশ্লেষণ
সৈয়দ তোশারফ আলী
প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
স্বৈরাচারী ও খুনি হাসিনার প্রতিকৃতি।
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গত এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে একটি পত্রিকায় বর্ষীয়ান অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের একটি চমৎকার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে। লেখাটির শিরোনাম ছিল, ‘একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ’ (প্রথম আলো, ২৩ এপ্রিল ২০২৫)। এর ঠিক পরের দিন ‘একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার পথরেখা’ শিরোনামে আরও একটি লেখা প্রকাশিত হয়। বস্তুত লেখাটি সুদীর্ঘ হওয়ায় পত্রিকাটি একটি লেখা দুই কিস্তিতে ভিন্ন শিরোনাম দিয়ে প্রকাশ করে।
ড. রেহমান সোবহানের বিশ্লেষণে কেবল অতীত নয়, সমকালীন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বিষয়ও সবিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। তার বিশ্লেষণ পড়তে গিয়ে এত দিনের নিরুত্তর কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা থেকে এ লেখাটির জন্ম। আলোচনার শুরুতে নিকট অতীত থেকে কিছু সময় ঘুরে আসি। সময়টা ১৯৬১ সাল। ইতোমধ্যে পাকিস্তানে সামরিক শাসন দৃঢ় মূল হয়ে বসেছে এবং যার প্রভাব শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।
ঠিক এ রকম পটভূমিতে ঢাকার ইসলামিক একাডেমিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক তরুণ অর্থনীতির শিক্ষক, পাকিস্তানি অর্থনীতির ওপর একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল ‘How to build Pakistan into a well-knit Nation’. সেদিনের এ তরুণ শিক্ষকই ছিলেন আজকের প্রাজ্ঞ রেহমান সোবহান। একথা অনস্বীকার্য, তার সেই প্রবন্ধটি ছিল মূলত ‘স্বাধিকার আন্দোলনের এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ’।
জাতীয় অর্থনীতির অবিভাজ্য চরিত্র সম্পর্কে সচেতন এবং সম্পর্ককে বিচ্ছিন্ন বা বিভক্ত করলে তার একক সত্তা থাকে না। এ সত্য অর্থনীতির ছাত্র হিসাবে রেহমান সোবহান সম্যকভাবে জানতেন বলেই আমাদের ধারণা। তারপরও তিনি পাকিস্তানের দুই অংশের বিকাশমান অর্থনীতির উন্নয়ন বিচারে পরিসংখ্যান তত্ত্ব ব্যবহার করে তার নিবন্ধে Dual Economic theory-এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি সেদিন জাতীয় অর্থনীতির অবিভাজ্যতাকে একদিকে উপেক্ষা করেন, অন্যদিকে অসম উন্নয়ন যে পুঁজিবাদী অর্থনীতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য-এ বৈজ্ঞানিক সত্যকেও আড়াল করেন।
এ কাজ করতে গিয়ে তিনি ঐক্যমুখীন ভাবনার জায়গায় সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে নিয়ে আসেন। তার এই ‘এক দেশ, দুই অর্থনীতি’ নতুন সংকটের সৃষ্টি করে। যে সংকট থেকে পাকিস্তান বেরিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়। তিনি ছিলেন মার্কসবাদী ঘরানার অর্থনীতিবিদ, কিন্তু শ্রমিকশ্রেণির দৃষ্টিতে আর্থ-রাজনীতির বিশ্লেষণে অপরিপক্ব। পাকিস্তানের অর্থনীতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি লক্ষ করেন, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অগ্রগতির চলচ্চিত্র দুই অংশে দুই ধরনের। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায়ও ভিন্নতা রয়েছে। এটা থাকাই ছিল স্বাভাবিক। কারণ, পূর্ববাংলাকে যখন পশ্চিমাংশের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি গঠন করা হয়, তখন পূর্ববাংলা ছিল একটি রুরাল স্লাম বা গ্রামীণ বস্তি।
একথা বাংলার গভর্নর ফ্রেডরিক বারোজ এবং পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু জোর দিয়েই বলেছিলেন। বারোজ চেয়েছিলেন বাংলাকে অখণ্ড রাখতে, আর নেহরু চেয়েছিলেন আপাতত পূর্ববাংলাকে পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হোক, তারপর অর্থনৈতিকভাবে ভায়াবেল না হতে পেরে পূর্ববাংলা ‘ঘরে ফিরে’ আসবে। তখন গোটা বাংলা হবে ভারত ইউনিয়নভুক্ত। এটাই ছিল নেহেরু ডকট্রিন। আমাদের ধারণা, এ ডকট্রিন সম্পর্কেও রেহমান সোবহানের সম্যক ধারণা ছিল।
তিনি ভালো করেই বুঝতেন, পুঁজিবাদী উন্নয়ন প্রক্রিয়া বৈষম্যমূলক না হয়ে পারে না। এ কারণে উন্নয়নের ক্ষেত্রে পাকিস্তানেও আঞ্চলিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু তার সমাধান খোঁজার দরকার ছিল পরিকল্পিত অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে। আর রাজনৈতিক ইতিহাস ও অভিজ্ঞতার আলোকে দাবি তোলা সমীচীন ছিল শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার। যার মূলকথা ছিল, ‘এক জাতি দুই দেশ’। তাহলে বিষয়টি ভিন্ন মাত্রা পেত। কিন্তু মুসলিম জাতিসত্তা সমুন্নত রাখার ব্যাপারে তার ছিল অনীহা। এমনকি রেহমান সোবহান যদি অসম উন্নয়নের প্রাসঙ্গিক উপসর্গকে পুঁজিবাদী বিকাশের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসাবে দেখতেন, তাহলেও পড়ার কারণ ও তার যৌক্তিক সমাধান হয়তো তিনি ভিন্নভাবে খুঁজতেন।
সে পথে তিনি যেমন হাঁটেননি, তেমনই অন্যদের মধ্যে আবু মাহমুদ, আখলাকুর রহমান, আনিসুর রহমান, নূরুল ইসলাম, মোজাফফর আহমদ, মোশাররফ হোসেনকেও হাঁটতে দেখা যায়নি। তারাও কমবেশি মার্কসবাদী অর্থনীতিতে প্রভাবিত ছিলেন। তবে তারা শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থের দৃষ্টিতে পাকিস্তানের অর্থনীতিকে বিচারবিশ্লেষণ করতে পেরেছিলেন বলে আমাদের জানা নেই। পারলে আমাদের বিশ্বাস বিপর্যয় এড়ানো যেত। একাত্তরের ভয়ংকর রক্তপাত এড়ানো যে সম্ভব হয়নি, তার একাধিক কারণের মধ্যে এটিও অন্যতম।
রাজনীতিতে ব্যক্তির বিস্ময়কর উত্থান এবং বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষের আত্মদান সমাজ পরিবর্তনে তখনই সার্থক ভূমিকা রাখতে পারে, যখন ঘোষিত লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ একদল কর্মী একাগ্র চিত্তে তা বাস্তবায়ন করতে লেগে যায়। যার অভাবে বাংলাদেশ এক ভয়ংকর পরিস্থিতির শিকার হয়। অর্থনীতির চেহারা আগের অবস্থায় ফেরানো কঠিন হয়ে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দুর্নীতি ও দুর্ভিক্ষ সাধারণ মানুষের চোখের ঘুম কেড়ে নেয়।
অনাহার থেকে বাঁচাতে কয়েক হাজার লঙ্গরখানা খোলা হয়। সোনার বাংলার স্বপ্ন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে গণতন্ত্রের বদলে একদলীয় ব্যবস্থাকে উপযোগী বিবেচনা করা হয়। ঘোষণা করা হয় দ্বিতীয় বিপ্লব। গঠন করা হয় বাকশাল। বদলে ফেলা হয় সংবিধান। ন্যাপ, সিপিবি ও ছাত্র-ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা উৎসাহ নিয়ে নতুন ব্যবস্থাকে স্বাগত জানায়।
রেহমান সোবহান সাহেবরাও এসব পদক্ষেপের অনুকূলে ছিলেন। দেশ সমাজতন্ত্রের দিকে যাচ্ছে দেখে অনেকের মধ্যেই উৎসাহ ছিল। কিন্তু সমাজতন্ত্রের একনিষ্ঠ সমর্থক তাজউদ্দিন সাহেবের কোনো সম্পৃক্ততা এর মধ্যে ছিল না। গড্ডালিকাপ্রবাহে গা না ভাসিয়ে রাজনৈতিক চরিত্রের বিশুদ্ধতা রক্ষায় দৃঢ়তা দেখিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক এমএজি ওসমানী ও ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। আসলে স্রোতের প্রতিকূলে চলার সাহস ও নৈতিক শক্তি সবার থাকে না। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিক্ষুব্ধ সেনারা এ নতুন বাকশালী পরিকল্পনার ইতি টেনে দেয়। পুরোনো কাসুন্দি না ঘেঁটে চলুন রেহমান সোবহান সাহেবের বিষয়ে ফিরে যাই।
প্রাজ্ঞ ব্যক্তি হিসাবে জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানকে তিনি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখছেন। তার সংগঠন সিপিডি (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) এবং তিনি নিজেও শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে ভারতকে করিডর দেওয়ার ব্যাপারে প্রভাবিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি শেখ হাসিনার পদক্ষেপকে ‘অচিন্তনীয়’ এবং আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীকে দেওয়া তার নির্দেশ ‘অমার্জনীয়’ বলেছেন। তার ভাষায়, ‘সেনাবাহিনী সৌভাগ্যবশত পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির পথে না হেঁটে তার আদেশ অমান্য করে সঠিক কাজ করেছে।’ তা না হলে ‘গণহত্যা ঘটে যেতে পারত।’
তার বিশ্লেষণে সেনাবাহিনীর নির্দেশ পালন না করার বিষয়টি যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, আন্দোলনে আপামরসাধারণের অংশগ্রহণের ব্যাপারটি ততটা গুরুত্ব পায়নি। উপরন্তু, তিনি দেখাতে চেয়েছেন এরকম আদেশ অমান্য করা ১৯৯০ সালে ও ২০০৭ সালেও ঘটেছিল। কিন্তু তার পেছনে ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে মূলত ছাত্র-জনতা। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে পলায়নি মনোভাব ছিল। সেনাবাহিনীকে নিরস্ত করার পেছনে জাতিসংঘের ভূমিকা ছিল।
রেহমান সাহেব বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ওপর জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের ৫ শতাধিক পাতার রিপোর্ট নির্ভরযোগ্য দলিল হিসাবে কাজ করবে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। শেখ হাসিনা তিনটি ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থেকে অর্থনৈতিক কাঠামোয় যেসব অপকর্ম করে গেছেন, তা তার ভাষায় ‘হতবাক’ করে দেওয়ার মতো। তিনি একটি টাস্কফোর্সের রিপোর্টের তথ্যকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছেন, যে রিপোর্টে অনেক ‘অন্ধকার’ দিক ফুটে উঠেছে। তার মতে, অপকর্মের ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে ব্যাংকিং খাতে।
তিনি তার বিশ্লেষণে সীমান্তের ওপারের দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘বিচ্যুত দৃষ্টিভঙ্গি’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তার লেখায় শব্দ ব্যবহার করার মুনশিয়ানাও চোখে পড়ার মতো। যেমন: শেখ হাসিনার ‘অন্তরঙ্গ পুঁজিপতি চক্রের লাগামহীন দুর্নীতি’, নির্বাচন জালিয়াতি, হত্যাকাণ্ড, মানবাধিকার লঙ্ঘন ইত্যাদি বিষয়গুলো ভারত সরকার সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে খেয়ালখুশিমতো কথা বলে যাচ্ছে। ফলে তা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। আমাদের জিজ্ঞাসা, ভারত কি আদৌ তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে চিন্তা করছে, না, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করে হৃত কলোনি পুনরুদ্ধার করার পরিকল্পনা করছে?
ভারতকে নিয়ে রেহমান সোবহান সাহেবরা বাক্য ব্যয় না করে আমাদের কী করণীয় তাই বলুন। মোদির ভারত এখন শুভবুদ্ধি থেকে বহুদূরে অবস্থান নিয়েছে। সম্মানজনক সম্পর্ক গড়া এবং তা বজায় রাখার জন্য কী করণীয়, তা ভারত ভালোই বোঝে। সে পথে হাঁটতে ইচ্ছুক নয় ভারত। সে চায় বাংলাদেশ তার শোষণের মৃগয়া ক্ষেত্র হিসাবে ব্যবহার করতে। ইসলামের সামাজিক সাম্যবাদকে বর্ণবাদী ভারত কখনো সহজভাবে নিতে পারেনি।
মুক্তবুদ্ধির দাবিদার মুসলিম ভাবুকদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা বিচারে মারাত্মক বিভ্রান্তি রয়েছে। মহাত্মা গান্ধী যাদের হরিজন বলতেন, সেই দলিত শ্রেণির লোকেরা ছিল ইংরেজ শাসকদের কাছে শিডিউলকাস্ট। এদের উন্নয়নের জন্য ম্যাকডোনাল্ড তার কমিউন্যাল অ্যাওয়ার্ডে কিছু সুবিধা সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখলে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে বনেদি হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা। কারণ, তাদের এটা বদ্ধমূল বিশ্বাস, নিুবর্ণের হিন্দুদের ইহজাগতিক উন্নয়ন হওয়ার নয়। পূর্বজন্মের পাপের ফল হচ্ছে ইহজাগতিক দুঃখ-দুর্দশা।
শিডিউলকাস্ট হিন্দুদের নেতা যোগেন্দ্র নাথ মণ্ডল এ কারণে মুসলমানদের সঙ্গে পাকিস্তান আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। বস্তুত, ভারত বিভক্তির মূলে ছিল ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের অনুদার মনোভাব ও অমানবিক আচরণ। ন্যায্যতার অভাব দেখা দিলে সহোদর ভাইয়ের সঙ্গেও মানুষ থাকতে পারে না। আলাদা হয়ে যায়।
আমাদের অভিজ্ঞতার নাতিদীর্ঘ ইতিহাসে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘটনায় এ সত্য প্রমাণিত। অনেক রক্ত, অনেক অশ্রু, অনেক বেদনা যুক্ত আছে এ ইতিহাসের সঙ্গে। কিন্তু সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমাদের এ সংগ্রামের কাহিনিকে একটি গ্রন্থের দুটি অধ্যায় হিসাবে কেউ উপস্থাপন করেনি।
১৯৪৭-এর অর্জনকে পরিত্যাগ করতে গিয়ে আমরা আমাদের মহান নেতাদের অবদানকে আড়ালে ঠেলে দিয়েছি। ১৯৭১-এর অর্জনকে বড় করতে গিয়ে ছোট মাপের নেতাদের ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে তুলতে চেষ্টা করেছি। এ হাস্যকর চেষ্টা থামিয়ে ছোট-বড় মিলিয়ে এক গ্যালাক্সিতে সবাইকে রাখলে সেটাই সবার প্রশংসা পেত। সৎ, সাহসী ও নির্লোভ বুদ্ধিজীবীর অভাবে সেটা হয়ে ওঠেনি। সেটা করা সম্ভব হলে আজ আর অনেককে ইতিহাসের সামনে জুবুথুবু দিয়ে দাঁড়াতে হতো না।
স্বল্পকালীন এ পার্থিব জীবনকে অর্থবহ করার নানা পথ ও পন্থা রয়েছে। ক্ষমতার নেশায় আসক্ত হলে অন্য নেশার মতো তা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হতে পারে, কিন্তু মেরে কেটে ক্ষমতায় থাকতে হবে কেন? ভুলভ্রান্তি এককথা আর প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে গুম, খুন, ফাঁসি কার্যকর করা ভিন্নকথা। রাজনীতি যদি জনকল্যাণের, সমাজ পরিবর্তনের উপায় না হয়, তাহলে সে রাজনীতি থেকে দূরে থাকাই সমীচীন।
তরুণদের উদ্দেশ্যে বলব, তোমাদের সামনে কেবল ইউরোপ আর আমেরিকাকে রেখো না, এশিয়ার দেশ চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার মতো দেশকেও রেখো। এসব দেশের তরুণ-তরুণীরাও দৃপ্তপদে জীবনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। দক্ষতা ও যোগ্যতায় তোমাদেরও তাদের সমকক্ষ হয়ে উঠতে হবে।
এ প্রসঙ্গে গাছের বেড়ে ওঠার উদাহরণ দিয়ে বলব, ঠিকমতো আলো-বাতাস, পানি আর সার পেলে যথাসময়ে ফুলেফলে ভরে উঠে গাছ, আর বেড়ে ওঠার কথা বলতে হয় না। দেশ-জাতির ভালোমন্দ নিয়ে যারা ভাবেন, তাদের চিন্তাভাবনার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী গ্রহণ-বর্জন করা শিখতে হবে। বিচারবিশ্লেষণের কষ্টিপাথরে যাচাই করতে হবে প্রত্যেককে। এজন্যই রেহমান সোবহানকে নিয়ে এ আলোচনা।
সৈয়দ তোশারফ আলী : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক




