সোশ্যাল মিডিয়ায় মুসলমানের আচরণ কেমন হবে
প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:১৯ পিএম
সোশ্যাল মিডিয়ায় মুসলমানের আচরণ। ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বর্তমান সময়ে সব মানুষের পাশাপাশি মুসলিমরাও তাদের মোবাইল কিংবা কম্পিউটারের কি-বোর্ড আর স্ক্রিনে গড়ে তুলেছে নিজেদের দ্বিতীয় জীবন। কিন্তু প্রশ্ন হলো- তারা কি অনলাইনে সত্যিই একজন মুসলমানের প্রতিনিধি? তাদের পোস্ট, কমেন্ট ও শেয়ার— আল্লাহর সন্তুষ্টি আনছে, নাকি গুনাহ?
সোশ্যাল মিডিয়ায় মুসলমানের আদর্শ আচরণ কেমন হবে; এ সম্পর্কে রয়েছে কুরআন-হাদিসের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। যা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-
১. আল্লাহ দেখছেন— অনলাইনেও!
অনলাইনে লেখা প্রতিটি শব্দ, দেওয়া প্রতিটি মন্তব্য— ফেরেশতারা লিপিবদ্ধ করছে। তাই পোস্ট দেওয়ার আগে একটু থেমে ভাবুন- ‘এটা কি আল্লাহর রেকর্ডে আমার পক্ষে যাবে নাকি বিপক্ষে?’ আল্লাহ তাআলা বলেন-
مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ
‘মানুষের মুখ থেকে কোনো কথা উচ্চারিত হয় না বরং তার পাশে প্রস্তুত থাকে একজন পর্যবেক্ষক।’ (সুরা ক্বাফ: আয়াত ১৮)
২. ভাষা ও মন্তব্যে সংযম রাখা
ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ যে কোনো মাধ্যমে যে মন্তব্যই করুন না কেন, খারাপ ভাষা, গালাগালি, ট্রল বা কটূ মন্তব্য করা ইসলামে নিষিদ্ধ। মানুষকে সুন্দরভাবে কথা বলার তাগিদ দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ قُوۡلُوۡا لِلنَّاسِ حُسۡنًا
‘মানুষকে সুন্দর কথা বল।’ (সুরা আল-বাকারা: আয়াত ৮৩)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন-
وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকাল বিশ্বাস করে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’ (বুখারি ৬১৩৬, মুসলিম ৪৭)
৩. যাচাই-বাছাই ছাড়া শেয়ার না করা
গুজব, অপ্রমাণিত খবর বা ‘forwarded message’ শেয়ার করা অনেক সময় অন্যের মানহানি বা সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ায়। যাচাই না করে পোস্ট, স্ক্রিনশট, ভিডিও বা খবর শেয়ার করা বিশাল গুনাহ। মুসলমান কখনো গুজব ছড়ায় না। আল্লাহ তাআলা বলেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِن جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا
‘হে মুমিনগণ! যদি কোনো পাপাচারী তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে যাচাই করো।’ (সুরা আল-হুজুরাত: আয়াত ৬)
৪. উপহাস ও অপমান এড়িয়ে চলা
কৌতুক, মিম বা ভিডিও যদি অন্যের অপমান হয়— সেটা আর বিনোদন নয় বরং গুনাহ। আল্লাহ তাআলা বলেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا یَسۡخَرۡ قَوۡمٌ مِّنۡ قَوۡمٍ عَسٰۤی اَنۡ یَّكُوۡنُوۡا خَیۡرًا مِّنۡهُمۡ وَ لَا نِسَآءٌ مِّنۡ نِّسَآءٍ عَسٰۤی اَنۡ یَّكُنَّ خَیۡرًا مِّنۡهُنَّ ۚ وَ لَا تَلۡمِزُوۡۤا اَنۡفُسَكُمۡ وَ لَا تَنَابَزُوۡا بِالۡاَلۡقَابِ ؕ بِئۡسَ الِاسۡمُ الۡفُسُوۡقُ بَعۡدَ الۡاِیۡمَانِ ۚ وَ مَنۡ لَّمۡ یَتُبۡ فَاُولٰٓئِكَ هُمُ الظّٰلِمُوۡنَ
হে মুমিনগণ! কোন সম্প্রদায় যেন অন্য সম্প্রদায়কে ঠাট্টা-বিদ্রূপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রূপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর নারীরা যেন অন্য নারীদেরক ঠাট্টা-বিদ্রূপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রূপকারিণীদের চেয়ে উত্তম। তোমরা একে অন্যের নিন্দা করো না, একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। ঈমান গ্রহণের পর (ঈমানের আগে কৃত অপরাধকে যা মনে করিয়ে দেয় সেই) মন্দ নাম কতই না মন্দ! (এ সব হতে) যারা তওবাহ না করে তারাই যালিম।’ (সুরা হুজুরাত: আয়াত ১১)
৫. গিবত, অপবাদ ও ব্যঙ্গ থেকে বাঁচুন
সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যের চরিত্রহনন, কারো ছবি বা ভিডিও নিয়ে মজা করা— এগুলো গিবত বা অপবাদ হতে পারে। যা গুনাহের কাজ। আল্লাহ তাআলা বলেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اجۡتَنِبُوۡا كَثِیۡرًا مِّنَ الظَّنِّ ۫ اِنَّ بَعۡضَ الظَّنِّ اِثۡمٌ وَّ لَا تَجَسَّسُوۡا وَ لَا یَغۡتَبۡ بَّعۡضُكُمۡ بَعۡضًا ؕ اَیُحِبُّ اَحَدُكُمۡ اَنۡ یَّاۡكُلَ لَحۡمَ اَخِیۡهِ مَیۡتًا فَكَرِهۡتُمُوۡهُ ؕ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ تَوَّابٌ رَّحِیۡمٌ
‘হে মুমিনগণ, তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাক। নিশ্চয় কোন কোন অনুমান তো পাপ। আর তোমরা গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের গিবত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোসত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দই করে থাক। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ অধিক তাওবা কবুলকারী, অসীম দয়ালু।’ (সুরা আল-হুজুরাত: আয়াত ১২)
৬. অহংকার ও প্রদর্শন এড়িয়ে চলা
সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের সম্পদ, রূপ, নাম-যশ বা দান-সদকা প্রদর্শন করা রিয়া (লোক দেখানো আমল) হতে পারে, যা আমল নষ্ট করে দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন-
لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ مِنْ كِبْرٍ
‘যার অন্তরে এক দানার পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (আবু দাউদ ৪০৯১)
৭. অযথা সময় নষ্ট না করা
ঘণ্টার পর ঘণ্টা সোশ্যাল মিডিয়ায় অর্থহীন স্ক্রল করে সময় নষ্ট করা মানুষকে আমল থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-
نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنْ النَّاسِ الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ
‘এমন দুটি নিয়ামত আছে, যে দুটোতে অধিকাংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। তা হচ্ছে, সুস্থতা আর অবসর।’ (বুখারি ৬৪১২)
৮. ভালো বিষয় প্রচার করা
ইসলামি জ্ঞান, দোয়া, কুরআনের আয়াত, হাদিস, সুন্দর আচরণের বার্তা— এগুলো প্রচার করা ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। তাই এগুলো দাওয়াতের কাজে ব্যবহার করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-
مَنْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أَجْرِ فَاعِلِهِ
‘যে ব্যক্তি ভালো কিছুর দিকে আহ্বান করে, তার জন্যও সেই আমলের সমান সওয়াব।’ (আবু দাউদ ৫১২৯)
৯. উত্তম চরিত্রই আসল ইসলাম
কমেন্টে রাগ নয়, কোমলতা আনুন। আলোচনা বা লেখালেখিতে তর্ক নয়, হিকমাহ ও ধৈর্য আনুন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ إِيمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا
‘ঈমানদারদের মধ্যে সবচেয়ে পরিপূর্ণ ঈমান সেই ব্যক্তির, যার চরিত্র সবচেয়ে উত্তম।’ (তিরমিজি ১১৬২)
মনে রাখতে হবে
> ভাষা ব্যবহার: ভালো ও শালীন হতে হবে
> খবর শেয়ার: যাচাই ছাড়া নয়
> অন্যের সমালোচনায়: গিবত ও অপবাদ নিষিদ্ধ
> অহংকার: রিয়া থেকে বাঁচতে হবে
> সময় ব্যবহার: অর্থবহ ও ইবাদতমূলক কাজে
> প্রচার: ভালো কাজের আহ্বান করা
তাই সোশ্যাল মিডিয়া কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়— বরং এটি আমলনামার অংশ, যেখানে আমাদের প্রতিটি পোস্ট, লাইক ও কমেন্টের হিসাব দেওয়া লাগবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রতিটি কথা ও কাজের হিসাব নেবেন। কুরআনে এসেছে-
مَا یَلۡفِظُ مِنۡ قَوۡلٍ اِلَّا لَدَیۡهِ رَقِیۡبٌ عَتِیۡدٌ
‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তা গ্রহণ করার জন্য তার কাছে সদা প্রস্তুত প্রহরী রয়েছে।’ (সুরা ক্বাফ: আয়াত ১৮)
তাই অনলাইন ও অফলাইন উভয় জীবনেই আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনায় নিজের জন্য এভাবে দোয়া করা-
اللَّهُمَّ أَصْلِحْ لِي قَوْلِي وَفِعْلِي فِي السِّرِّ وَالْعَلَنِ
উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা আসলিহ লি ক্বাওলি ওয়া ফে’লি ফিস সিররি ওয়াল আ’লানি।’
অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য কথাবার্তা ও কাজকে আপনি সংশোধন করে দিন।’
পরিশেষে মুসলমান শুধু মসজিদে নয়, তার ইসলাম অনলাইনেও ঝলমল করবে। আপনি যখন ‘সেন্ড’ বাটনে চাপ দেবেন, তখন শুধু ভেবে নেবেন— ‘এই কথায় কি আল্লাহ খুশি হবেন?’

