বিবাহবিচ্ছেদের পর সন্তান কার কাছে থাকবে
ইসলাম ও জীবন ডেস্ক
প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৫৮ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ইসলামে পরিবার একটি পবিত্র আমানত। দাম্পত্য সম্পর্ক ভেঙে গেলেও সন্তানের প্রতি দায়িত্ব কখনো ভেঙে যায় না। বাবা–মায়ের বিচ্ছেদের পর সবচেয়ে সংবেদনশীল প্রশ্নটি হলো— সন্তান কার কাছে থাকবে? ইসলাম ও দেশের প্রচলিত মুসলিম পারিবারিক আইন এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সন্তানের কল্যাণকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কারণ, একটি নিষ্পাপ শিশুর ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার নিরাপত্তা, ভালোবাসা ও সঠিক পরিচর্যার ওপর।
আইন অনুযায়ী অভিভাবকত্ব ও জিম্মাদারি
মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, বাবা হলেন অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের আইনগত অভিভাবক। আর মা হচ্ছেন সন্তানের তত্ত্বাবধায়ক বা জিম্মাদার। সন্তানের সর্বোত্তম কল্যাণের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে দেশে প্রচলিত মুসলিম আইন মাকে নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত সন্তানের জিম্মাদারির অধিকার দিয়েছে। এ অনুযায়ী, ছেলেশিশু সাত বছর বয়স পর্যন্ত এবং মেয়েশিশু তার বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত মায়ের জিম্মায় থাকার অধিকারী।
বাবার দায়িত্ব কখনো শেষ হয় না
নাবালক সন্তান যে অভিভাবকের কাছেই থাকুক না কেন, সন্তানের খোঁজখবর নেওয়া, লালন-পালন এবং ভরণপোষণের দায়িত্ব আইনগতভাবে বাবার ওপরই বর্তায়। অর্থাৎ সন্তান মায়ের জিম্মায় থাকলেও তার মৌলিক প্রয়োজন, শিক্ষা ও জীবিকার দায় বাবা এড়িয়ে যেতে পারেন না। সন্তানের ভরণপোষণ ও দায়িত্ব পালনের বিষয়টি যে বাবার ওপর তা কুরআনের নির্দেশনায় সুস্পষ্ট। আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَعَلَى الْمَوْلُودِ لَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ ۚ
‘যার সন্তান জন্ম দিয়েছে (বাবা), তার দায়িত্ব হলো মায়ের ভরণপোষণ ও পরিধেয়ের ব্যবস্থা করা ন্যায়সঙ্গতভাবে।’ (সুরা আল-বাকারা: আয়াত ২৩৩)
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট হয়— বিবাহবিচ্ছেদ হলেও সন্তানের ভরণপোষণ বাবার দায়িত্ব এবং সন্তান মায়ের জিম্মায় থাকলেও খরচ বহনের দায়িত্ব বাবার।
আইন নির্ধারিত বয়সের পরও মায়ের কাছে থাকা
সন্তানের সার্বিক মঙ্গল ও মানসিক সুস্থতার জন্য যদি প্রয়োজন হয়, তবে আইন নির্ধারিত বয়সসীমা পার হওয়ার পরও মা সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি অনুযায়ী আদালতের অনুমতির প্রয়োজন হতে পারে। তাছাড়া সন্তানের লালন-পালনে মায়ের দায়িত্ব বেশি এবং অগ্রাধিকার। কেননা সন্তানের ব্যাপারে হাদিসে মাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে—
এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন—
يَا رَسُولَ اللَّهِ، مَنْ أَحَقُّ النَّاسِ بِحُسْنِ صَحَابَتِي؟
‘হে আল্লাহর রাসুল! আমার কাছে সবচেয়ে বেশি উত্তম আচরণ পাওয়ার হকদার কে?
তিনি (সা.) বললেন—
أُمُّكَ
‘তোমার মা’
তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর কে?
তিনি বললেন—
أُمُّكَ
‘তোমার মা’
আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর কে?
তিনি বললেন,
أُمُّكَ
‘তোমার মা’
আবার (চতুর্থ বার) জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর কে?
তারপর (চতুর্থ বার) বললেন,
ثُمَّ أَبُوكَ
‘তোমার বাবা’। (বুখারি: ৫৯৭১, ৫৫৪৬ ইফা)
এ হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয়— সন্তানের জীবনে মায়ের অধিকার ও ভূমিকা সর্বাধিক আর লালন-পালন ও মানসিক নিরাপত্তায় মায়ের অগ্রাধিকার ইসলামে স্বীকৃত।
আদালতের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি
পুরোনো আইনে ছেলেশিশুকে সাত বছর এবং মেয়েশিশুকে বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত মায়ের জিম্মায় রাখার কথা বলা হলেও সুপ্রিমকোর্টের সাম্প্রতিক একাধিক রায়ে বলা হয়েছে— এখন আর কেবল বয়সকে একমাত্র মানদণ্ড ধরা যাবে না। বর্তমান আইনি অবস্থান অনুযায়ী, প্রতিটি মামলায় শিশুর সবচেয়ে ভালো স্বার্থ কোথায় নিহিত, সেটিই প্রধান বিবেচ্য বিষয়। আদালত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে শিশুকে বাবা বা মায়ের জিম্মায় দিতে পারেন। প্রয়োজনে দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানির কাছেও জিম্মা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
ইসলাম আমাদের শেখায়— সন্তান কোনো পক্ষের সম্পত্তি নয় বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া এক মহান আমানত। বিবাহবিচ্ছেদ বাবা–মায়ের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করলেও সন্তানের অধিকার ও কল্যাণকে কখনো ক্ষতিগ্রস্ত করা উচিত নয়। আইন ও আদালতের সিদ্ধান্তের মূল লক্ষ্য হলো— শিশুটি যেন ভালোবাসা, নিরাপত্তা ও নৈতিক পরিবেশে বেড়ে উঠতে পারে। শেষ পর্যন্ত বাবা-মা উভয়েরই দায়িত্ব হলো নিজেদের বিরোধ ভুলে সন্তানের জন্য সবচেয়ে উত্তম পথটি বেছে নেওয়া।
