Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

বদনজর সম্পর্কে কুরআন-হাদিসে কী বলা আছে?

Icon

আব্দুল হান্নান হামিদি

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:৪৯ পিএম

বদনজর সম্পর্কে কুরআন-হাদিসে কী বলা আছে?

ছবি: সংগৃহীত

মানুষের জীবন সুখ–স্বাচ্ছন্দ্য, সুস্থতা ও নিরাপত্তার ওপর যেমন আল্লাহর রহমত নির্ভরশীল, তেমনি হিংসা, বিদ্বেষ ও কুদৃষ্টির মতো অদৃশ্য বিষয় থেকেও সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। অনেক সময় দেখা যায়, সুস্থ মানুষ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে, স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় অজানা বাধা আসে কিংবা অকারণে বিপদ ঘিরে ধরে—যার পেছনে দৃশ্যমান কারণের পাশাপাশি অদৃশ্য কারণও থাকতে পারে। ইসলামি পরিভাষায় এই অদৃশ্য ক্ষতিকর প্রভাবকেই বলা হয় ‘বদনজর’।

ইসলাম বদনজরকে কুসংস্কার হিসেবে নয়; বরং আল্লাহর ইচ্ছায় সংঘটিত একটি বাস্তব বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কুরআনের আয়াত ও হাদিসে বদনজরের অস্তিত্ব, এর কুপ্রভাব এবং তা থেকে আত্মরক্ষার পথনির্দেশ স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নবী–রাসুলদের ঘটনা, সাহাবায়ে কেরামের আমল এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশনা আমাদের জন্য সুস্পষ্ট দলিল বহন করে।

কুরআন ও হাদিসের আলোকে বদনজরের বাস্তবতা, এর ক্ষতিকর প্রভাব এবং ইসলামে প্রতিকার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত অথচ প্রামাণ্য আলোচনা উপস্থাপন করা হলো। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন—

وَ قَالَ یٰبَنِیَّ لَا تَدۡخُلُوۡا مِنۡۢ بَابٍ وَّاحِدٍ وَّ ادۡخُلُوۡا مِنۡ اَبۡوَابٍ مُّتَفَرِّقَۃٍ ؕ وَ مَاۤ اُغۡنِیۡ عَنۡكُمۡ مِّنَ اللّٰهِ مِنۡ شَیۡءٍ ؕ اِنِ الۡحُكۡمُ اِلَّا لِلّٰهِ ؕ عَلَیۡهِ تَوَكَّلۡتُ ۚ وَ عَلَیۡهِ فَلۡیَتَوَكَّلِ الۡمُتَوَكِّلُوۡنَ

‘ইয়াকুব (আ.) বললেন, ‘হে আমার প্রিয় সন্তানগণ! তোমরা সবাই এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করো না; বরং বিভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। আমি তোমাদের আল্লাহর নির্ধারিত কোনো বিষয় থেকে রক্ষা করতে পারি না। ফয়সালার অধিকার কেবল আল্লাহরই। তার ওপরই আমি ভরসা করি, আর ভরসাকারীদের উচিত তার ওপরই ভরসা করা।’ (সুরা ইউসুফ: আয়াত ৬৭)

পরবর্তীতে আল্লাহ বলেন, তাদের এভাবে প্রবেশ করা আল্লাহর নির্ধারিত কোনো বিষয় ঠেকাতে পারেনি; তবে এটি ছিল ইয়াকুব (আ.)-এর অন্তরের একটি কামনা, যা তিনি পূর্ণ করেছিলেন। নিশ্চয়ই তিনি সেই জ্ঞান রাখতেন, যা আমরা তাকে শিক্ষা দিয়েছিলাম; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। (সুরা ইউসুফ: আয়াত ৬৮)

হাফেজ ইবনে কাসির (রহ.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেন— এ ঘটনাটি তখনকার, যখন ইয়াকুব (আ.) তার পুত্র বিনইয়ামিনকে অন্য ভাইদের সঙ্গে মিসরে পাঠান। ইবনে আব্বাস (রা.), মুহাম্মদ ইবনে কাব, মুজাহিদ, যাহহাক, কাতাদা ও সুদ্দী (রহ.) প্রমুখ বলেন— ইয়াকুব (আ.) এ নির্দেশ দিয়েছিলেন বদনজরের আশঙ্কায়। কারণ তার সন্তানরা ছিলেন সুদর্শন ও সুঠাম দেহের অধিকারী। তবে তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন— এই ব্যবস্থা আল্লাহর তাকদিরকে প্রতিহত করতে পারবে না। আল্লাহ যা চান, তাই হয়। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর হুকুমেই এ ব্যবস্থা বদনজর থেকে রক্ষার মাধ্যম হয়েছিল। (তাফসির ইবনে কাসির: ২/৪৮৫)

অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন—

وَإِنْ يَكَادُ الَّذِينَ كَفَرُوا لَيُزْلِقُونَكَ بِأَبْصَارِهِمْ ...

‘কাফিররা যখন কুরআন শোনে, তখন তারা যেন তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির দ্বারা তোমাকে আছড়ে ফেলতে চায় এবং বলে, ‘নিশ্চয়ই সে একজন উন্মাদ।’ (সূরা কলাম: আয়াত ৫১)

ইবনে কাসির (রহ.) ইবনে আব্বাস (রা.) ও মুজাহিদ (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন—

(لَيُزْلِقُونَكَ) অর্থাৎ তারা তোমার ওপর বদনজর দিতে চায়, যাতে হিংসার প্রভাবে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ো— যদি না আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করেন। এ আয়াত প্রমাণ করে যে, বদনজরের কুপ্রভাব বাস্তব এবং তা আল্লাহর ইচ্ছায় সংঘটিত হয়। (তাফসির ইবনে কাসির: ৪/৪১০)

হাদিসে বদনজরের প্রমাণ

১. হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

الْعَيْنُ حَقٌّ ‏"‏‏.‏ وَنَهَى عَنِ الْوَشْمِ

‘বদ নজর লাগা সত্য। আর তিনি উল্কি আঁকতে (খোদাই করতে) নিষেধ করেছেন।’ (বুখারি ৫৩২৯)

২. হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত—

 اسْتَعِيذُوا بِاللَّهِ فَإِنَّ الْعَيْنَ حَقٌّ

‘তোমরা বদনজর থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও; কারণ বদনজর সত্য।’ (ইবনে মাজাহ ৩৫০৮)

৩. ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

الْعَيْنُ حَقٌّ وَلَوْ كَانَ شَيْءٌ سَابَقَ الْقَدَرَ سَبَقَتْهُ الْعَيْنُ وَإِذَا اسْتُغْسِلْتُمْ فَاغْسِلُوا

‘বদনজরের প্রভাব সত্য। কোনো জিনিস যদি তাকদিরকে অতিক্রম করতে পারত, তাহলে বদনজর তাকে অতিক্রম করত। তোমাদেরকে গোসল করতে বলা হলে তোমরা গোসল করবে এবং গোসলে ব্যবহৃত পানি দিয়ে রোগীর চিকিৎসা করবে।’ (মুসলিম, কিতাবুস্ সালাম ২১৮৮/৪২)

৪. আসমা বিনতে উমাইস (রা.) বলেন—

 أَنَّ أَسْمَاءَ بِنْتَ عُمَيْسٍ، قَالَتْ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ وَلَدَ جَعْفَرٍ تُسْرِعُ إِلَيْهِمُ الْعَيْنُ أَفَأَسْتَرْقِي لَهُمْ فَقَالَ- نَعَمْ فَإِنَّهُ لَوْ كَانَ شَيْءٌ سَابَقَ الْقَدَرَ لَسَبَقَتْهُ الْعَيْنُ ‏

‘আসমা বিনতে উমাইস (রা.) বলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! জাফরের সন্তানদের তাড়াতাড়ি বদনজর লেগে যায়। আমি কি তাদেরকে ঝাড়-ফুঁক করতে পারি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। কেননা, কোনো জিনিস যদি ভাগ্যকে অতিক্রম করতে পারত তাহলে বদনজরই তা অতিক্রম করতে পারত।’ (তিরমিজি ২০৫৯)

৫. হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত যে, নবী (সা.) বলেছেন—

أَكْثَرُ مَنْ يَمُوتُ مِنْ أُمَّتِي بَعْدَ قَضَاءِ اللَّهِ وَقَدَرِهِ بِالْعَيْنِ

‘আমার উম্মতের মধ্যে তাকরিরের মৃত্যুর পর সর্বাধিক মৃত্যু বদনজর লাগার দ্বারা হবে।’ (মুসনাদে বাযযার)

৬. হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত—

كَانَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ يَأْمُرُنِي أَنْ أَسْتَرْقِيَ مِنَ الْعَيْنِ

নবী (সা.) আমাকে বদনজর থেকে বাঁচার জন্যে ঝাড়-ফুঁক করার নির্দেশ দিতেন।’ (বুখারি ১০/১৭০, মুসলিম ২১৯৫)

কুরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে প্রমাণিত যে, বদনজর একটি বাস্তব সত্য। এটি আল্লাহর ইচ্ছায় মানুষের শরীর, মন ও জীবনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই ইসলামে বদনজর থেকে বাঁচতে আল্লাহর ওপর ভরসা করা, দোয়া করা এবং শরিয়তসম্মত ঝাড়-ফুঁক গ্রহণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম