মস্তিষ্কের ব্যায়ামে বই পড়া
ডা. অপূর্ব চৌধুরী
প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বই পড়তে ভালোবাসেন? একটি বই হাতে নিন। বই পছন্দ করেন? মার্কেটে গেলেন, একটি বইয়ের দোকানের সামনে একটু দাঁড়ান। নতুন কোথাও ঘুরতে গেছেন, কাছে একটি লাইব্রেরি থাকলে ঘুরে আসুন।
মানুষ কেন বই পড়ে! বই কি কেবল রাশি রাশি জ্ঞানের আধার! নাকি বই পড়ে একদিকে আমরা যেমন কিছু জানতে পারি, আরও ভালো বুঝতে পারি, একই সঙ্গে আমাদের মন এবং শরীরের ওপর বইয়ের কি সত্যি কোনো প্রভাব আছে। বই কি আমাদের চিন্তাকেই কেবল সমৃদ্ধ করে! বই কি কোনোভাবে আমাদের সুস্থ রাখে শারীরিকভাবে!
হ্যাঁ, বইয়ের সঙ্গে শরীরের একটি সম্পর্ক আছে। বই শরীরকে সুস্থ রাখে। বই মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে, ফোকাস পাওয়ার বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি বাড়ায়, স্মৃতিক্ষয় রোগ প্রতিরোধ করে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, বিষণ্নতা থেকে রক্ষা করে, ঘুম আনতে সাহায্য করে, ঘুমের কোয়ালিটি বাড়ায়, দুশ্চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়, মানসিক ভারসাম্য তৈরি করে, কোষের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে শরীরের আয়ু বাড়ায়, সর্বোপরি মন, শরীর এবং মস্তিষ্ককে বই ভালো রাখে এবং শক্তিশালী করে।
বই জ্ঞানের ধারক। বই জ্ঞানের আধার। আমরা যখন বই পড়ি, আমাদের মস্তিষ্ক সবচেয়ে একটিভ থাকে। শরীরের পেশিগুলোকে সচল করতে যেমন ব্যায়ামের বিকল্প নেই, বই পড়া হলো মস্তিষ্কের ব্যায়াম। বইয়ের সঙ্গে মস্তিষ্কের এ সম্পর্ক কেবল মস্তিষ্ককে ভালো রাখে না। সঙ্গে শরীর ভালো রাখে, মন ভালো রাখে, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, কাজে মনোযোগ বৃদ্ধি করে, মনকে সতেজ রাখে, বিষণ্নতা এবং একঘেয়েমি থেকে বের করে আনে। এমন করে বললে আরও বলা যায়। এক কথায় বলি পড়া আপনার জ্ঞান বা জানাকে বৃদ্ধি করে না, আপনার ভালো ঘুম আনায়, অস্থির মনকে সুস্থির করে, স্মৃতিশক্তি ক্ষয় রোধে বইয়ের ভূমিকা পরীক্ষিত, অবসন্নতা, ক্লান্তি, উদ্বিগ্নতা প্রতিরোধে বইয়ের বিকল্প নেই, বই সহজে কোনো কিছুতে একাগ্রতা বাড়ায়, মজা লাগলে তো কথাই নেই, বই হলো সবচেয়ে জীবন্ত বিনোদন। বইয়ের অনেক গুণগান করলাম। কিন্তু শুধু দাবি করলেই তো হবে না! কী করে বই আমাদের শরীর, মন, মস্তিষ্ক, এমনকি হৃৎপিণ্ডে প্রভাব ফেলে, বলছি তার কথা।
প্রতিদিন নিয়ম করে ২০ মিনিট হলেও ঘরের একটি কোনা বেছে নিন। একটি বই নিয়ে তাতে হারিয়ে যান। সে সুযোগ বা পরিবেশ না থাকলে কাজে যাচ্ছেন, গাড়িতে, বাসে, ট্রেনে বসে আছেন, বই পড়ুন। বিকালে হাঁটতে বের হলেন, পারলে একটি বই সঙ্গে নিন, পার্কের নীরব কোনো বেঞ্চিতে বসুন, মাত্র একটি পাতা পড়ুন। সারা দিনের সব অতৃপ্তিগুলো মুহূর্তে উড়ে যাবে। ফুরফুরে মন নিয়ে বাসায় ফিরবেন।
বাচ্চাদের সঙ্গে বসে টিভি না দেখে, ফোন হাতে সোশ্যাল মিডিয়াতে না ঘুরে, ঘুমের আগে বাচ্চাদের পাশে শুয়ে শুয়ে সাউন্ড করে বই পড়বেন, তাকেও পড়াবেন। নতুন নতুন বিষয় তার সঙ্গে শেয়ার করবেন, পাশে শুয়ে শুয়ে তাকে পড়তে বলবেন তার প্রিয় বইটি। এতে বাচ্চার সঙ্গে আপনার সম্পর্কটি গভীর হবে, বাচ্চাটি আনন্দের সঙ্গে শিখবে, জীবনকে কৌতূহলের চোখ দিয়ে জানতে চাইবে। বাচ্চাটি নিজের মধ্যে নিরাপদ বোধ করবে। এমন করে বই পড়ায় বাচ্চাদের সঙ্গে বাবা-মায়ের সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে, বাচ্চারা কনফিডেন্ট হয়, মানবিক বোধ বাড়ে এবং বাচ্চাদের মানসিক বয়স সমৃদ্ধ হয়।
মূলকথায় আসি। সুস্থ শরীরের জন্য বই পড়ার জরুরি নিয়ে আলোচনা। বই মনের ওপর প্রভাব রাখার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ওপর বিভিন্নভাবে প্রভাব ফেলে। এদের অন্যতম হলো মস্তিষ্ক। মস্তিষ্কে বই পড়ার সবচেয়ে বেশি প্রভাব। আমাদের চিন্তাশক্তি হলো মস্তিষ্কের কোষ নিউরনের কিছু নেটওয়ার্ক। এ নেটওয়ার্ক যত শক্তিশালী হয়, আমাদের চিন্তাশক্তি বাড়ে। এক গবেষণায় দুই সপ্তাহ ল্যাবরোটরিতে পর্যবেক্ষণ করে সঙ্গে মস্তিষ্কের গজও স্ক্যান করে দেখা গেছে বই মস্তিষ্কের নেটওয়ার্ক অ্যাকটিভ করে, আগের চেয়ে শক্তিশালী, নতুন সংযোগ, অধিক স্থায়ী করে।
ব্যক্তিকে এবং সামাজিক সফলতার একটি মূল যোগ্যতা-কমিউনিকেশন। অন্যকে বোঝা, অন্যকে বুঝানো। জবের ক্ষেত্রে অন্যতম সফলতা নিজের চিন্তাকে প্রকাশযোগ্য ক্ষমতায় আসা। লেখে প্রকাশ হোক, বলে প্রকাশ হোক, যে কোনো প্রকাশযোগ্য ক্ষমতার প্রভাব সামাজিক প্রভাব বিস্তারের অন্যতম কাঠি। কমিউনিকেশনের মতো অন্যতম লাইফ স্কিলের মূল শর্ত শব্দ! যত বেশি শব্দের সংগ্রহ, তত বেশি প্রকাশের ধার। বইয়ের বিকল্প আর কোনোটাই নেই। সামাজিক স্কিল আপনাকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করবে, আপনার শরীর মনকে ভালো রাখবে। বই, বিশেষ করে গল্প উপন্যাস এবং তার মধ্যে কোনো লাগা চরিত্র, সে চরিত্রের মানবিক দোষ গুণ, যোগ্যতা অযোগ্যতা, সর্বোপরি মানবিক বোধ বাড়ায়, মানবিক হতে সাহায্য করে, সহিষ্ণু এবং পরের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে। বই মানবিক করে তোলে মনকে।
