Logo
Logo
×

বাতায়ন

রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে এশিয়ান মহাসড়কের গুরুত্ব

Icon

মিফতাহুর রহমান

প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে এশিয়ান মহাসড়কের গুরুত্ব

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের সঠিক পর্যালোচনা ও এর বাস্তবতার আলোকে পররাষ্ট্রনীতি, ভূ-রাজনীতি ও আন্তঃদেশীয় যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ভূ-রাজনীতিতে ভারত ও মিয়ানমার দুই প্রতিবেশী এবং তাদের সঙ্গে সংযুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা ও পারস্পরিক বাণিজ্য উন্নয়ন একটি জরুরি বিষয়।

স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের পারস্পরিক উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বাণিজ্য ও অর্থনীতি। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতীয় প্রদেশগুলোর সঙ্গে রেল, সড়ক ও আকাশপথে পূর্ণাঙ্গ যোগাযোগ স্থাপনের যেমন বিকল্প নেই, তেমনি এ যোগাযোগব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে মিয়ানমারের সঙ্গেও। বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি শুরু ২০১৭ সালে, যখন মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্যে সামরিক ক্র্যাকডাউন করে এবং জীবনরক্ষার্থে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বাংলাদেশ সীমানা অতিক্রম করে নাফ নদী বরাবর টেকনাফ-কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারে জাতিগত, ধর্মীয় নিপীড়ন, অত্যাচার, ধর্ষণ ও হত্যা থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্নভাবে ও বিভিন্ন পথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় যেমন-মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে পালিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের জন্য বাংলাদেশকে অবকাঠামো তৈরিসহ বিভিন্ন সেবা, শিক্ষা, পানি, স্যানিটেশন, দুর্যোগ মোকাবিলা, সামাজিক নিরাপত্তা, সংক্রামক রোগ ও চিকিৎসার এক বিরাট চ্যালেঞ্জ নিতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়ন হলে তা উভয় দেশকেই বাণিজ্য ক্ষেত্রে উন্নয়নের পথে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। মিয়ানমারের প্রধান রপ্তানিযোগ্য পণ্য হলো প্রাকৃতিক গ্যাস এবং এরপর হলো শুকনা শিম, সেগুন কাঠ, খনিজ, রত্ন ইত্যাদি। অন্যদিকে প্রধান আমদানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম, শিল্প কাঁচামাল, ভোগ্যপণ্য ইত্যাদি। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সেতুবন্ধনকারী দেশ, যা গুরুত্বপূর্ণ ভূ-কৌশলগত স্থানে অবস্থিত। আবার মিয়ানমার তার ভূ-কৌশলগত অবস্থানের জন্য ভারত, চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া চীনের ‘বেল্ট ও সড়ক’ উদ্যোগ, যা নতুন সিল্ক রোড হিসাবে পরিচিত, ২০১৩ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং কর্তৃক গৃহীত একটি অতি উচ্চাভিলাষী অবকাঠামো প্রকল্প। এ প্রকল্পে পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপকে সংযুক্ত করার প্রাথমিক পরিকল্পনা থাকলেও এটি এখন আফ্রিকা, ওশেনিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করবে। চীনের এ পরিকল্পনার পেছনে অর্থনৈতিক ও রাজনীতির বলয় সম্প্রসারণ কাজ করছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

বর্তমানে চীন জ্বালানি সংকট মেটাতে মিয়ানমারের জ্বালানি মজুতে প্রবেশপথ তৈরির চেষ্টা করছে। ভারতও তার ভবিষ্যৎ জ্বালানি সংকট নিরসনে মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকেও তার ভূ-কৌশলগত অবস্থানের জন্য ও ভবিষ্যৎ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে হবে। মিয়ানমার একদিকে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে যেমন সার্কভুক্ত দেশগুলোতে বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে পারবে, তেমনি বাংলাদেশ আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোয় বাণিজ্য প্রসারে মিয়ানমারের মধ্যস্থতা ব্যবহার করতে পারে। ঐতিহাসিকভাবে রাখাইন রাজ্য যদিও একটি বিপজ্জনক ভৌগোলিক অবস্থানে অবস্থিত; কিন্তু বাংলাদেশ-মিয়ানমারের জন্য রাখাইন প্রদেশ হলো ব্যবসার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। বাংলাদেশ যেমন রাখাইন প্রদেশের কৃষিপণ্যের একটি মূল্যবান বাজার হতে পারে, তেমনি রাখাইন প্রদেশ বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালস, পোশাক শিল্প, কৃষি প্রযুক্তির জন্য একটি সম্ভাবনাময় বাজার। এ ছাড়া বাংলাদেশ-মিয়ানমার রাখাইন প্রদেশে যৌথ বাজার সংগঠনসহ একে অপরের জনশক্তি বিনিময়ের ভিত্তিতে প্রচুর মুনাফা অর্জন করতে পারে। মোটকথা, সংঘাতের সব পথ পরিহার করে এ দুই দেশের অর্থনৈতিক প্রগতির পথ ত্বরান্বিত করা বাঞ্ছনীয়। ভৌগোলিকভাবে রাখাইন প্রদেশ পর্যটন শিল্পের একটি হটস্পট। বাংলাদেশে অবস্থিত বৌদ্ধ মঠগুলো মিয়ানমারসহ সার্ক ও আসিয়ানভুক্ত বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলো যেমন-থাইল্যান্ড, জাপান ও শ্রীলংকার এক বিরাট পর্যটন আকর্ষণ।

মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের মধ্যে ২০৮ কিলোমিটার (১২৯.২ মাইল) ভূমিসীমান্ত এবং ৬৪ কিলোমিটার (৩৯.৫ মাইল) নদীসীমান্ত। ইতঃপূর্বে ২০০৭ সালে এ দুই দেশের মধ্যে সড়কপথ নির্মাণের দুটি প্রস্তাব বাস্তবায়ন হয়নি। পরে এ দুই দেশের মধ্যে ১৩০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়, যেখানে দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের রামু হয়ে রাখাইনের ঘুমধুমকে সংযোগ করার প্রস্তাব ছিল। প্রস্তাবিত এ প্রকল্পটি ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের একটি অংশ, যা বাস্তবায়িত হলে রেলপথে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরকে যুক্ত করত বাংলাদেশ। এদেশে বিদ্যমান তিনটি সমুদ্রবন্দর-চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে; তাই জাপানি তহবিল সংস্থা জাইকার অর্থায়নে মহেশখালী-মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। নির্মিতব্য এ গভীর সমুদ্রবন্দরের লজিস্টিক (রসদ) ক্ষমতা বৃদ্ধি করে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়ন ঘটাতে পারে। এ ছাড়া এই গভীর সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ৩৬টি উন্নয়নমূলক প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার মধ্যে কয়লাচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, বিশেষ বাণিজ্য অঞ্চল ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস টার্মিনাল অন্যতম। উল্লেখ্য, মহেশখালী-মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর সরাসরি জাতীয় মহাসড়কে সংযোজিত হবে। এ ছাড়া ২০২৪ সাল নাগাদ এ গভীর সমুদ্রবন্দর রেলপথে দোহাজারী-কক্সবাজার লাইনকে সংযুক্ত করবে। জাপান সরকার ও বেসরকারি খাতে গৃহীত ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এ প্রকল্প ধাপে ধাপে শেষ হতে ২০৩০ সাল লেগে যেতে পারে। এদিকে চীন-মিয়ানমার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের উন্নয়নে পশ্চিম রাখাইন প্রদেশের কাইউকফাইউ শহরকে কেন্দ্র করে গভীর সমুদ্রবন্দরসহ ৩০টি প্রকল্প ‘বেল্ট ও রোড’ উদ্যোগের আওতায় ত্বরান্বিত হবে। বিশেষ বাণিজ্য অঞ্চলও এ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। মিয়ানমার-চীন গৃহীত মহাসড়ক ও রেলপথ, যা মিয়ানমার থেকে চীনের ইউনান প্রদেশ পর্যন্ত ভবিষ্যতে প্রসারিত হবে, তার সঙ্গে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা উন্মোচন হতে পারে। অন্যদিকে চীনের ইউনান প্রদেশ থেকে বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সমুদ্রবন্দরসহ থাইল্যান্ডের সঙ্গে নতুন সীমান্ত পারাপার, যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলাও চীন-মিয়ানমার যৌথ উদ্যোগের অংশ।

বাংলাদেশকে তার বাণিজ্য সুবিধা গ্রহণের প্রক্রিয়া হিসাবে শান্তিপূর্ণ কূটনীতি ও পেশাদারি পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করে চীনের ‘বেল্ট ও রোড’ আন্তঃদেশীয় ও আন্তঃমহাদেশীয় উদ্যোগ, যা ভবিষ্যতে ভূমি ও জলপথে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপকে চীনের সঙ্গে সংযুক্ত করবে-সেই প্রকল্পের সঙ্গে সংযুক্ত হতে অভ্যন্তরীণ সমুদ্রবন্দরগুলো এবং সড়ক ও রেলপথ উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে হবে। ‘এশিয়ান মহাসড়ক’, যা এশিয়া ও ইউরোপ-এ দুই মহাদেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করবে, তা প্রায় ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ৩২টি এশীয় দেশ ও ইউরোপের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করবে।

প্রস্তাবিত এ মহাসড়কের আওতায় একটি রুট ঢাকা থেকে সিলেটের তামাবিল হয়ে, ভারত ও মিয়ানমার হয়ে, হো চি মিন সিটি, হ্যানয়, বেইজিং, সিউল হয়ে টোকিও শহরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবে। অন্য আরেকটি রুট বাংলাদেশের সীমান্ত শহর বেনাপোল হয়ে, কলকাতা, নয়াদিল্লি, লাহোর, ইসলামাবাদ, কাবুল, তেহরান হয়ে, ইস্তাম্বুল হয়ে শেষ হবে। এশিয়ান মহাসড়কের আওতায় ৮৮টি বিভিন্ন রুটের মধ্যে তিনটি রুট-AH1 (তামাবিল-বেনাপোল, ৪৯২ কিলোমিটার ), AH2 (তামাবিল-বাংলাবান্ধা, ৫১৭ কিলোমিটার) এবং AH41 (টেকনাফ-মোংলা, ৭৬২ কিলোমিটার)-ঢাকাকে সংযোগ করে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যাবে। এখানে লক্ষণীয়, AH41 রুটটি সরাসরি মিয়ানমারকে সংযোগ করতে পারবে।

বাংলাদেশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট সড়ক ও জনপথ বিভাগ ‘এশিয়ান মহাসড়ক’র অভ্যন্তরীণ, আন্তঃদেশীয় ও আন্তঃমহাদেশীয় গুরুত্ব উপলব্ধি করে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যথাসময়ে সম্পৃক্ত হতে না পারলে ভবিষ্যতে আমরা বৈশ্বিক অর্থনীতি ও ভূ-রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ব এবং এর পরিণতিতে মিয়ানমার-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক শিথিল হয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আরও কঠিন হয়ে যাবে। রোহিঙ্গা সমস্যা একদিকে যেমন ‘এশিয়ান মহাসড়ক’ তথা ভূ-রাজনীতির ফল, তেমনি এর নিরসনে দরকার এ প্রকল্পের সঙ্গে বাংলাদেশের সঠিক সম্পৃক্ততা ও সময়োচিত পদক্ষেপ।

মিফতাহুর রহমান : শিক্ষাবিদ, গবেষক, বিজ্ঞান ও কারিগরি পরামর্শক

miftahur1710@gmail.com

 

রোহিঙ্গা সংকট নিরসন এশিয়ান মহাসড়ক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম