শতফুল ফুটতে দাও
আসন্ন ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের তাৎপর্য
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদের নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এবার ডাকসুতে ভিপি, জিএসসহ পদ ২৮টি। গত নির্বাচনে (২০১৯) পদ ছিল ২৫টি। এবার ৩টি পদ বাড়ানো হয়েছে। আর প্রতিটি হল সংসদে নির্বাচন হবে ১৩টি পদে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন হল আছে ১৮টি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ডাকসুর ২৮টি পদের জন্য ৫৬৫ জন মনোনয়নপত্র কিনেছেন। আর ১৮ হল সংসদের বিভিন্ন পদের জন্য ১ হাজার ২২৬ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। যাচাই-বাছাই শেষে আজ প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করা হবে।
ডাকসু ও হল সংসদগুলোয় সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৯ সালে। সে নির্বাচন থেকে ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর একজন রাজনৈতিক নেতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। ডাকসু ও হল সংসদের গুরুত্বপূর্ণ পদে অতীতে যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে বেশ কজন জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছেন এবং আজ পর্যন্ত জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। সেজন্যই অনেক সময় বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদগুলো জাতীয় রাজনীতির সূতিকাগার। ২০১৯ সালে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের পর দীর্ঘ ৬ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু কোনো নির্বাচন হয়নি। এখন সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ২০১৯ সালের নির্বাচন বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। তখন নির্বাচন নিয়ে কারচুপির অভিযোগ উঠেছিল। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে কোনো নির্বাচনই যে কারচুপিমুক্ত থাকে না, ২০১৯-এর ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন তারই স্বাক্ষর বহন করে। শেখ হাসিনার শাসনকালকে যেসব কারণে ফ্যাসিবাদের কাল হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, তার মধ্যে ২০১৯ সালে ডাকসু ও হল নির্বাচনে ছাত্রলীগের হস্তক্ষেপ বিশেষভাবে উল্লেখ্য হয়ে আছে। তারও আগে খোদ মুজিব আমলে ডাকসু নির্বাচনে মুজিববাদি ছাত্রলীগের ভরাডুবি নিশ্চিত জেনে ডাকসুর ব্যালট বাক্স হাইজ্যাক করা হয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংসদ নির্বাচনকে কলুষিত করে পুরো নির্বাচনব্যবস্থাকে পরবর্তীকালে কলুষিত করা হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সময়ে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হয়, কিন্তু সেসব নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন করতে কোনো হস্তক্ষেপ হয়েছিল বলে জানা যায় না। এরশাদের আমলেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে। প্রথাগতভাবে ডাকসু ও হল সংসদগুলো স্টাবলিশমেন্টবিরোধী হলেও এরশাদের আমলে একজন ডাকসু জিএস এরশাদকে সমর্থন প্রদান করেন। অভিযোগ আছে, তাকে অনেক টাকার বিনিময়ে কিনে ফেলা হয়েছিল। পরে এই ব্যক্তি এরশারে মন্ত্রী হন। তিনি জাতীয় পার্টির নেতৃত্বেও বরিত হন। স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশেও বিভিন্ন গণ-আন্দোলন ও গণ-অভুত্থানে ডাকসু ও হল সংসদগুলো গৌরবমণ্ডিত সংগ্রামী ভূমিকা রেখেছে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির আইয়ুববিরোধী ও শিক্ষা আন্দোলন, চৌষট্টির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে ডাকসু ও হল সংসদগুলো ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে।
পাকিস্তানের ২৩ বছরজুড়ে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। সে সময়কার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও স্বাধিকারের সংগ্রামে ভূমিকা পালন করাই ছিল যুক্তিযুক্ত। ওই সময়ের ছাত্রনেতারা সাধারণ ছাত্রদের ওপর জুলুম-অত্যাচার করেছেন অথবা তাদের মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করেছেন, এমন নজির নেই। তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নামে দুটি বড় ছাত্র সংগঠন ছিল। এ সংগঠন দুটির পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী শাখা-প্রশাখা ছিল। এছাড়াও ‘পাকিস্তান ছাত্রশক্তি’ নামে আরেকটি ছাত্র সংগঠন ছিল। এ সংগঠনটি ইসলামি জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী ছিল। তবে তাদের মধ্যে কোনো ধরনের উগ্রতা ছিল না। পাকিস্তান আমলে সরকার সমর্থক একটি ছাত্র সংগঠন ছিল, যার নাম এনএসএফ বা ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন। যদিও এ সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৫৭ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খান প্রাদেশিক সরকারের কিছু কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করার জন্য, পরবর্তীকালে আইয়ুব-মোনায়েমের ধামাধরা হয়ে পড়ে এটি। কনভেনশন মুসলিম লীগের সরকারকে সমর্থন করতে গিয়ে এরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে হেন অপকর্ম নেই, যা তারা করেনি। তাদের টার্গেট ছিল ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ও সমর্থকরা। কখনো কখনো ছাত্রলীগও তাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। তাদের গণবিরোধী চরিত্র নিয়ে অনেক কথা বলার থাকলেও এই কলামের পরিসরে সেসব আলোচনার সুযোগ নেই। তারা মূর্তিমান ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রাষ্ট্রীয় মদদে। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এ সংগঠনটি বিলুপ্তির পথে চলে যায়।
বর্তমান ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হচ্ছে ২০২৪-এর মহান গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পর। এ অভ্যুত্থানের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ কেমন ছিল, তা কারও অজানা নয়। গণরুম ও গেস্টরুমের অত্যাচার এবং ছাত্রলীগের মিছিলে যেতে বাধ্য করা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য ছাত্র সংগঠনগুলো ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে পারত না। ভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক আছে জানলে ছাত্রলীগ অন্য ছাত্রদের ওপর নানা রকম জুলুম-নির্যাতন চালাত। দেশবাসী নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি, ছাত্রলীগের নেতাদের প্রতি সমীহ না করার কারণে এক ছাত্রকে শীতের রাতে খোলা আকাশের নিচে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় এবং তার ওপর দৈহিক নির্যাতন চালানো হয়। এ দুর্ভাগা ছাত্রটি ছিল একজন দরিদ্র লোকের সন্তান। ছাত্রলীগের মাস্তানদের প্রহার ও শীতের ঠান্ডায় ছাত্রটির মৃত্যু ঘটে। এ নিয়ে তদন্ত কমিটি হলেও কোনো বিচার হয়নি। তার অসহায় পিতা-মাতার অভিশাপ বর্ষিত হয়েছে শেখ হাসিনা ও তার দলবলের ওপর।
২০২৪-এর মহাগণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে এবারের ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচন ভিন্ন তাৎপর্য বহন করে। গণ-অভ্যুত্থানের পর গেস্টরুম ও গণরুমের নিপীড়ন বন্ধ হয়েছে। এখন কোনো ছাত্র সংগঠন সাধারণ ছাত্রদের মিছিল-মিটিংয়ে যোগ দিতে জবরদস্তি করে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ পরিস্থিতি কতকাল অব্যাহত থাকবে? দেশে আগামী দিনে জাতীয় সংসদের নির্বাচন হবে। এ নির্বাচনের পর কোনো একটি দলের সরকার গঠিত হবে। তখন ক্ষমতাসীনদের ছাত্রছায়ার তাদের সমর্থক ছাত্র সংগঠন দুর্বিনীত হয়ে উঠুক, এটা কারও কাম্য নয়। তাই যদি হয়, তাহলে বুঝতে হবে এত রক্ত ও অশ্রুপাত আমাদের মন-মানসিকতাকে বদলাতে পারেনি। তেমনটি ঘটলে তা হবে খুবই দুঃখজনক ও মর্মান্তিক। আমি আশা করব নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ছাত্র সংগঠন ও মোর্চাগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্রসংস্কৃতির নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক পরিবেশ উন্নত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করবে, সেটাই কাম্য। ডাকসু ও হল সংসদকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, সাহিত্য প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতা, সংগীত ও নাট্যচর্চা ইত্যাদিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিমণ্ডল সরগরম হয়ে উঠবে। সব ছাত্র সংগঠনের মধ্যে বিরাজ করবে সহনশীলতা ও পরস্পরকে শ্রদ্ধা করার সংস্কৃতি। হল কেন্টিনে গায়ের জোরে ফাও খাওয়ার অপসংস্কৃতি রোধ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব দেবেন, তারা সবাই হবেন নিয়মিত ছাত্র।
মিডিয়ার কাছে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেত্রীরা তাদের করণীয় নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে আশান্বিত হয়েছি। তবে সামান্য ব্যতিক্রম বাদে সবগুলো ছাত্র সংগঠন কোনো না কোনো জাতীয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাধা। এসব দলের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটলে তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত ছাত্র সংগঠনগুলোর সম্পর্কে অবনতি ঘটতে পারে। এটাই ভয়ের কথা।
একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এবারের ডাকসু নির্বাচনের ৪টি ফ্যাক্টর ক্রিয়াশীল হবে। এসব ফ্যাক্টরের কথা সংবাদপত্রটি অবগত হয়েছে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ করে। প্রথম ফ্যাক্টর-ভোটারদের ৪৭.৫২ শতাংশ ছাত্রী। দ্বিতীয় ফ্যাক্টর-জগন্নাথ হলের ভোট (২ হাজার ২১৯ জন, এ ভোটারদের সবাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের)। তৃতীয় ফ্যাক্টর-জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে কার কী ভূমিকা ছিল। ৪র্থ ফ্যাক্টর-প্রার্থীদের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি। এ ফ্যাক্টরগুলোর সবকটিই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে বিশেষ ভূমিকা রাখবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে ছাত্রীদের ভোট বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রীদের নিয়ামক ভূমিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলেই বিশ্বাস করতে চাই। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্রী এবং নারীরা সাহসী ভূমিকা পালন করেছে। তারা ছিল সাহস ও প্রেরণার উৎস। কখনো কখনো তাদের ঢাল তাদের ভাইদের রক্ষা করেছে। সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আজ ছাত্রীদের যে অবস্থান, তা আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী হতে উৎসাহী করে। তবে একথা সত্য যে, জুলাই অভ্যুত্থানে নারীরা ঊর্মিমালার মতো যেভাবে এগিয়ে এসেছিল, এখন তারা জাতীয় মঞ্চে সে ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এটা দুশ্চিন্তার বিষয়, সন্দেহ নেই। জগন্নাথ হল ফ্যাক্টরটিও উপেক্ষা করার মতো নয়। এরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। অনেক কারণই আছে, যার ফলে এরা সংখ্যাগুরুদের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না। অথবা মেলায় না। রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের শক্তি-সামর্থ অর্জনে এই তালহীনতা একটি বড় বাধা। এটি দূর করতে হবে। সর্বশেষে বলতে হয়, ৯ সেপ্টেম্বর ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের ফলাফল থেকে আমরা বুঝতে পারব, আমাদের তরুণ প্রজন্ম কী ভাবছে এবং কী তাদের আকাঙ্ক্ষা।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

