jugantor
আখেরি ধান্ধায় ছাত্রলীগ ভয়াবহ বেপরোয়া

  মুসতাক আহমদ  

২৬ জুন ২০১৩, ০০:০০:০০  | 

অভিভাবক প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতার শেষদিকে এসে লাগামহীন হয়ে পড়েছে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগ ও যুবলীগ। বিশেষ করে ছাত্রলীগ এখন ভয়াবহ রকমের বেপরোয়া। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ যতটা না তার চেয়ে বেশি হিংস্র হয়ে গেছে ঢাকার বাইরের শাখাগুলো। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ, তাদের কারণে এক সপ্তাহে দু’টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আরও বেশ কয়েকটিতে চলছে অস্থিরতা। আর খুন হয়েছে অন্তত ৩ জন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংঘর্ষ-সংঘাতে জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেয়া, লোক দেখানো বহিষ্কার ও গ্রেফতার- এমনকি ছাত্রলীগ-যুবলীগের কমিটিতে সন্ত্রাসী-মাস্তান ও ক্যাডারদের স্থান দেয়ায় বেপরোয়া ভাব বাড়ছেই।

বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই এই দু’টি সংগঠন বিশেষ করে ছাত্রলীগ চরম বেপরোয়া হয়ে পড়ে। এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রথম ১৭ মাসে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী ঘটনা ছিল ১৫৮টি। তখনকার বেশিরভাগ সহিংস ঘটনা অবশ্য নিজেদের মধ্যেই ঘটেছে। তাদের হাতে ওই সময়ে নিহত হয় ৯ জন, আহত ১ হাজার ৯৪৭। ঘটনায় জড়িত থাকায় আটক ও গ্রেফতার হয় ২৪১। তখন সারাদেশে মামলা হয় ২১৪ জনের নামে। আর সংগঠন থেকে বহিষ্কার হয় ২৬৪ জন। প্রথম ১৭ মাসে তাদের কারণে ৩৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়।

এরপরও তাদের লাগাম টানা সম্ভব হয়নি। এই ব্যর্থতায় অভিমান করে ছাত্রলীগের ‘সাংগঠনিক নেত্রী’র পদ থেকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ৪ এপ্রিল পদত্যাগ করেছিলেন। এরপর অনেকবার দলের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘ছাত্রলীগে শিবির ঢুকে পড়েছে’। কিন্তু সেই শিবির যেমন চিহ্নিত করা হয়নি, তেমনি বেশির ভাগ ঘটনার নায়ককে গ্রেফতার করা হয়নি। বরং সন্ত্রাসীদের অনেকে বহাল তবিয়তে রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এক সপ্তাহে ছাত্রলীগ দেশের অধিকাংশ সরকারি ও বেশকিছু বেসরকারি কলেজে ভর্তি বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে। স্বার্থসিদ্ধির জন্য কোথাও তারা শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করেছে। আবার কোথাও ছাত্রছাত্রীদের মারধর করে ট্রান্সক্রিপ্ট ও সার্টিফিকেট আটকে ভর্তি বাণিজ্য নিশ্চিত করে। হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা। এর বাইরে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাজে বাধা দেয়া, থানায় ঢুকে আসামি ছিনিয়ে নেয়া, ওসিকে লাঞ্ছিত করা, আধিপত্য বিস্তার, বিলবোর্ড বাণিজ্য, গ্র“প-উপগ্র“পে বিভক্ত হয়ে সংঘর্ষ-মারামারিসহ বিভিন্ন নেতিবাচক ঘটনার জš§ দিচ্ছে নেতাকর্মীরা। সর্বশেষ মঙ্গলবারও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে কুমিল্লায় আবদুল আজিজ নামে এক শিবির কর্মী খুন হন। এর আগে সোমবার চট্টগ্রামে এক শিশুসহ ২ জন খুন হয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের গোলাগুলিতে। সংঘর্ষের জের ধরে ২২ জুন বন্ধ করে দিতে হয়েছে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এর আগে ১৬ জুন বন্ধ হয়ে যায় চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্রলীগ আর যুবলীগের এভাবে বেপরোয়া ও লাগামহীন হওয়ার প্রধান কারণ সরকারের মেয়াদ ৫ বছর পূর্ণ হতে আর দেরি নেই। তাই বেশির ভাগ নেতাকর্মী আখেরি ধান্ধায় নেমে পড়েছে। সারাদেশে যেসব দফতরের মাধ্যমে উন্নয়ন কাজ হচ্ছে, নিয়মিত মিছিল-মিটিং বা লেখাপড়া বাদ দিয়ে সেসব ভবনে সার্বক্ষণিক লেগে থাকছে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী। এরফলে ওইসব ভবনে আগে থেকে টেন্ডারবাজিতে লিপ্ত যুবলীগ বা অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাদের বিবাদ হচ্ছে। এই বিবাদ অবশ্য বেশির ভাগই অপ্রকাশিত থাকছে। কিন্তু দফারফা না হওয়ায় চট্টগ্রামে সোমবারের ঘটনা বন্দুকযুদ্ধের রূপ নেয়। সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, ছাত্রলীগ থেকে ইতিপূর্বে বিতাড়িত বা অবসর নেয়া বেশকিছু ব্যক্তির যুবলীগ বা অন্যান্য সহযোগী সংগঠনে পুনর্বাসিত হওয়াও প্রকাশ্য দ্বন্দ্বের কারণ। একযুগেরও বেশিদিন ধরে ঢাকার শিক্ষাভবন নিয়ন্ত্রণ করছেন ছাত্রলীগ থেকে একসময়ে বহিষ্কৃত নেতা শফিক। সম্প্রতি তিনি যুবলীগে একটি সম্পাদক পদ লাভে সক্ষম হন। শিক্ষাভবন-সচিবালয়-সেগুনবাগিচা এলাকায় ব্যাপক পোস্টারিং করে নিজের রাজনৈতিক পুনর্বাসনের বিষয়টি জানান দেন তিনি। এরপর থেকে শিক্ষাভবন, বিদ্যুৎভবন, পিডব্লিউডি, খাদ্যভবন এলাকায় তার মাস্তানি বেড়ে যায়। এমনকি তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের প্রভাবশালী সদস্যদের নাম পর্যন্ত ভাঙিয়ে থাকেন। এভাবে আরও বেশকিছু ব্যক্তি যুবলীগসহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠনে পাওয়া পদের অপব্যবহার করছেন। ফলে দুর্নাম হচ্ছে সরকার ও দলের। ঘটছে অঘটন।

পুলিশ ও ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সূত্র জানায়, একমাসে ছাত্রলীগ অন্তত অর্ধ-শতাধিক সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে। এরমধ্যে বড় ঘটনাটি ঘটেছে সোমবার চট্টগ্রামে। নগরীর কোতোয়ালি থানার সিআরবি এলাকায় সাত রাস্তার মোড়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের দেড় কোটি টাকার টেন্ডার দখলকে কেন্দ্র করে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের দু’গ্র“পের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে শিশুসহ দু’জন নিহত হন। নিহতরা হলেনÑ সাজু পালিত (২৮) এবং মোঃ আরমান হোসেন (৮)। আরমান স্থানীয় দরিদ্র রিকশাচালক মোঃ সিদ্দিকের ছেলে। জানা গেছে, ওই ঘটনায় যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও টেন্ডার কাজে ফোর স্টারখ্যাত হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক সাইফুল আলম লিমন গ্র“পের মধ্যে এ সংঘর্ষ বাধে। ঘটনার পর অবশ্য লিমনকে সংগঠন থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানান কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম। ঘটনার পর অভিযান চালিয়ে পুলিশ ৫২ জনকে আটক করে বলে জানা গেছে।

সোমবার দুপুরে চট্টগ্রামের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সন্ধ্যায় যুবলীগ-ছাত্রলীগ যৌথভাবে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে শিবিরের সঙ্গে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে পূর্বশত্র“তার জের ধরে শিবিরকর্মী আবদুল আজিজকে (২৫) পিটিয়ে হত্যা করা হয়। আজিজ উপজেলার আলকরা ইউনিয়নের দক্ষিণ সোনাইচ্ছা গ্রামের ইব্রাহিম মিয়ার ছেলে। সোমবার এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

এর আগে রোববার ক্লাস রুমে বসাকে কেন্দ্র করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম সিরাজুল ইসলাম গ্র“পের কর্মীদের মধ্যে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে। এতে অন্তত পাঁচজন আহত হয়। জবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এ ব্যাপারে বলেন, ছাত্রদল কর্মীদের উস্কানীতে জুনিয়র ছাত্রলীগ কর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮ জুন তিন সাংবাদিককে পেটায় ছাত্রলীগের কর্মীরা। ওই ঘটনায় তিনজনকে মৌখিকভাবে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেন সভাপতি এফএম শরীফুল ইসলাম।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে শিক্ষক আন্দোলনে অচল রয়েছে। এই আন্দোলনের কারণও ছাত্রলীগ। এক কর্মী একজন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করে। শিক্ষকরা এর বিচার চেয়ে না পেয়ে এখন তারা ক্যাম্পাসই অচল করে দিয়েছেন।

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি কার্যক্রম চলছে। ছাত্রলীগ কিশোর এই শিক্ষার্থীদের ভর্তি নিয়েও বাণিজ্যে মেতে ওঠে। রাজধানীর ঢাকা কলেজ, কবি নজরুল, বাঙলা কলেজ, তিতমীর কলেজসহ দেশের ২৭৭টি সরকারি কলেজের এই একই দশা। জানা গেছে, কলেজে তারা ভর্তির জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক আসন চেয়েছে। আবার কোনো কলেজে আসন নয়, প্রায় সব ভর্তিই তাদের মাধ্যমে করানোর বায়না ধরেছে। ঢাকা কলেজে ভর্তির জন্য ১০০ আসন দাবি করা হয়। এ নিয়ে তারা প্রশাসনকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। পাশাপাশি ক্যাম্পাসে একের পর এক মহড়াও দিচ্ছে ছাত্রলীগ। এমনকি গত বৃহস্পতিবার প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মহড়া ও ফাঁকা গুলি ছুড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও নিউমার্কেট থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমানের দাবি, কলেজে গুলির ঘটনা ঘটেনি। কবি নজরুল কলেজে প্রত্যেক ভর্তি থেকেই টাকা দাবি করা হচ্ছে। ভর্তিপ্রতি তারা ১৫-২০ হাজার টাকা দাবি করছে। ছাত্র সংসদের নেতা পরিচয়ে সোহেল, মামুন এবং অহিদ গ্র“পকে এই অর্থ দিতে হবে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ভর্তি বাণিজ্যের বাইরে সংঘর্ষের ঘটনা অহরহ।

২৩ জুনেই ছাত্রলীগের ইচ্ছা অনুসারে একাদশ শ্রেণীতে (অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে) শিক্ষার্থী ভর্তি না করায় নীলফামারী সরকারি কলেজে ভাঙচুর চালিয়েছে তারা। এতে পুরো কলেজে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সাময়িক সময়ের জন্য একাদশ শ্রেণীর ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। একইদিন সিলেট এমসি কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তির সিট ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের বিবদমান দুই গ্র“প অস্ত্রের মহড়া দিয়েছে। এ সময় ক্যাম্পাসে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। একই সময়ে পার্শ্ববর্তী সিলেট সরকারি কলেজে ছাত্রলীগের ভর্তি বাণিজ্য ও প্রশাসনের অনিয়মের বিরুদ্ধে মিছিল বিক্ষোভ করে ভাংচুর চালিয়েছে ছাত্রদল।

২২ জুন কুমিল্লার লাকসামে নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজে ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবির সংঘর্ষ হয়। এতে আহত হয় ১২ জন। জানা গেছে, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা শহরে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুর করে। এ ঘটনায় রোববার সকালে ছাত্রশিবির নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। ছাত্রলীগ কর্মীরাও বিকালে মিছিল বের করে। এরপরই বাধে সংঘর্ষ। সংঘর্ষ ও ভাংচুরের ঘটনায় লাকসাম থানায় পৃথক ২টি মামলা ও ১টি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। একইদিন পছন্দের শিক্ষার্থীদের ভর্তি না করায় সিলেট এমসি কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের অপেক্ষমাণ তালিকা ছিঁড়ে ফেলেছে ছাত্রলীগ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, এমসি কলেজ ছাত্রলীগের লুৎফুর, পলাশ, সৌরভ, আকাশ, রায়হান, কনকের নেতৃত্বে ১০ থেকে ১৫ জনের একটি গ্র“প নিজেদের পছন্দমাফিক ভর্তি করাতে চায়। প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ভর্তি কমিটির প্রধান শফিক নেওয়াজসহ শিক্ষকদের গালিগালাজ করে এবং দেয়ালে টানানো অপেক্ষামাণ তালিকাটি ছিঁড়ে ফেলে।

২২ জুনেই আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মধ্যে সংঘর্ষের পর পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবিপ্রবি) ২৫ জুন পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর আগে ১১ জুন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) ছাত্রলীগের দু’গ্র“পে সংঘর্ষের জের ধরে বিশ্ববিদ্যালয় সাতদিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। ওইদিন বিকাল ৩টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়। মূলত ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে এ ঘটনা ঘটে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র নায়েব আহত হয়।

গত ২০ জুন ছাত্রলীগের পদবঞ্চিত নেতাকর্মীদের হাতে প্রহƒত হন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ছাত্র জুয়েল মজুমদার। গায়ে রিকশার ধাক্কা দেয়ার অভিযোগ এনে চেতনা ’৭১-এর সামনে পদবঞ্চিত ছাত্রলীগ কর্মী সুলতানুল আলম সাইফ, শফিকুর রহমান শফিক, বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা আহসানুল হক বাবু ও মোস্তাকিম আহমেদ মোস্তাকের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ কর্মীরা এক রিকশাচালকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। এর প্রতিবাদ করায় তাকে মারধর করা হয়। একইদিন চট্টগ্রামে সড়ক অবরোধ করে গাড়ি ভাংচুর করেছে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনাসটিটিউট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বিকাল ৫টার দিকে পাঁচলাইশ থানার ষোলশহর দু’নম্বর গেট সড়ক অবরোধ করে তারা। এ সময় ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ। আটককৃত তিনজন হলÑ শহীদুল ইসলাম (২৬), অজয় দে (২৩) এবং আবু ফয়েজ (২৩)।

২০ জুন লক্ষ্মীপুর সদরের চন্দ্রগঞ্জ কফিল উদ্দিন ডিগ্রি কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি ‘ফি’ তিন হাজার টাকা নির্ধারণ করার প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করেছে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল। এ সময় তারা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করে ও ভর্তি ফি কমানোর দাবি জানায়। বৃহস্পতিবার দুপুরে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল যৌথভাবে এ হামলা চালায়।

১৯ জুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শোডাউন করে ছাত্রলীগ। পরে তারা সমাবেশ করে। নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মধ্যে সংঘর্ষে পুলিশসহ আহত হয়েছে অন্তত ২০ জন। ১৮ জুন একাদশ শ্রেণীতে অবৈধ ভর্তি বাণিজ্যের সুযোগ না পেয়ে কুমিল্লার লাকসামের নওয়াব ফয়েজুন্নেসা সরকারি কলেজের প্রশাসনিক ভবনের প্রধান ফটক ও ভর্তি নিয়ন্ত্রণ কক্ষে তালা লাগিয়ে দিয়েছে ছাত্রলীগ। ১১ জুন চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে রাজধানী গুলশান-২ সিটি কর্পোরেশনের একটি মার্কেটে ব্যাপক ভাংচুর করেছে মহানগর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। রাত ৭টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা ১৫-২০টি দোকান ভাংচুর ও লুটপাট করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য

সার্বিক ব্যাপারে জানতে চাইলে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সভাপতি এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ বলেন, দেশের যেখানেই ছাত্রলীগের নামে অঘটন ঘটছে, তার বেশির ভাগই ব্যক্তিগত স্খলন; দলীয় নয়। আসলে ছাত্রলীগ নামধারী কিছু সন্ত্রাসীর কারণে ৬৪ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনের সুনাম নষ্ট হতে পারে না। সন্ত্রাসী বা অপরাধী যেই হোক, তার নিস্তার নেই। তিনি বলেন, যখনই কোনো নেতিবাচক ঘটনা ঘটে, তখনই অ্যাকশন চালানো হয়। প্রথমে সাময়িক বহিষ্কার করে পরে ঘটনা তদন্ত করে প্রয়োজনে আজীবন বহিষ্কারের রেকর্ড রয়েছে। তিনি আরও বলেন, তারা দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা মোকাবেলা করেন। সেই ঘটনায় বাণিজ্যের চেষ্টার অভিযোগে কবি নজরুল কলেজের কমিটি ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও বিভিন্ন স্থানে কমিটি ভেঙে দেয়ার ঘটনা রয়েছে। এছাড়া ব্যক্তিগত স্খলনের দায় না নিয়ে সাতক্ষীরা জেলা ও পিরোজপুর জেলা কমিটি ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। সুতরাং তারা এ বার্তা দিতে চাচ্ছেন যে, ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে কোনো অপরাধ করলে তা বরদাস্ত করা হবে না।

সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম বলেন, ছাত্রলীগ কোনো সন্ত্রাসী বা অপরাধীর জায়গা নয়। তাদের দায় ছাত্রলীগ নেয় না, নেবেও না। সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ যারা করেছে তাদের সংগঠন থেকে ইতিমধ্যে বের করে দেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতেও তাড়িয়ে দেয়া হবে। যারা অপরাধী তাদের ছাত্রলীগ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে ও সাংগঠনিক শাস্তি দেয়া হয়েছে। দেশের প্রচলিত আইনে ওইসব অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার লক্ষ্যে গ্রেফতারের দায়িত্ব আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর। এখন তারা (আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী) যদি তাদের দায়িত্ব পালন না করে সেক্ষেত্রে ক্ষোভ প্রকাশ ছাড়া কিছুই করার নেই। আর এক্ষেত্রে অপরাধীরাও সাহস পেয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, যেহেতু অপরাধীরা বহিষ্কৃত, তাই তারা ছাত্রলীগের কেউ নয়। অপরাধীকে ধরলে ছাত্রলীগের কোনো পর্যায় থেকে তদবির করা হবে না।


 

সাবমিট

আখেরি ধান্ধায় ছাত্রলীগ ভয়াবহ বেপরোয়া

 মুসতাক আহমদ 
২৬ জুন ২০১৩, ১২:০০ এএম  | 

অভিভাবক প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতার শেষদিকে এসে লাগামহীন হয়ে পড়েছে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগ ও যুবলীগ। বিশেষ করে ছাত্রলীগ এখন ভয়াবহ রকমের বেপরোয়া। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ যতটা না তার চেয়ে বেশি হিংস্র হয়ে গেছে ঢাকার বাইরের শাখাগুলো। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ, তাদের কারণে এক সপ্তাহে দু’টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আরও বেশ কয়েকটিতে চলছে অস্থিরতা। আর খুন হয়েছে অন্তত ৩ জন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংঘর্ষ-সংঘাতে জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেয়া, লোক দেখানো বহিষ্কার ও গ্রেফতার- এমনকি ছাত্রলীগ-যুবলীগের কমিটিতে সন্ত্রাসী-মাস্তান ও ক্যাডারদের স্থান দেয়ায় বেপরোয়া ভাব বাড়ছেই।

বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই এই দু’টি সংগঠন বিশেষ করে ছাত্রলীগ চরম বেপরোয়া হয়ে পড়ে। এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রথম ১৭ মাসে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী ঘটনা ছিল ১৫৮টি। তখনকার বেশিরভাগ সহিংস ঘটনা অবশ্য নিজেদের মধ্যেই ঘটেছে। তাদের হাতে ওই সময়ে নিহত হয় ৯ জন, আহত ১ হাজার ৯৪৭। ঘটনায় জড়িত থাকায় আটক ও গ্রেফতার হয় ২৪১। তখন সারাদেশে মামলা হয় ২১৪ জনের নামে। আর সংগঠন থেকে বহিষ্কার হয় ২৬৪ জন। প্রথম ১৭ মাসে তাদের কারণে ৩৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়।

এরপরও তাদের লাগাম টানা সম্ভব হয়নি। এই ব্যর্থতায় অভিমান করে ছাত্রলীগের ‘সাংগঠনিক নেত্রী’র পদ থেকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ৪ এপ্রিল পদত্যাগ করেছিলেন। এরপর অনেকবার দলের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘ছাত্রলীগে শিবির ঢুকে পড়েছে’। কিন্তু সেই শিবির যেমন চিহ্নিত করা হয়নি, তেমনি বেশির ভাগ ঘটনার নায়ককে গ্রেফতার করা হয়নি। বরং সন্ত্রাসীদের অনেকে বহাল তবিয়তে রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এক সপ্তাহে ছাত্রলীগ দেশের অধিকাংশ সরকারি ও বেশকিছু বেসরকারি কলেজে ভর্তি বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে। স্বার্থসিদ্ধির জন্য কোথাও তারা শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করেছে। আবার কোথাও ছাত্রছাত্রীদের মারধর করে ট্রান্সক্রিপ্ট ও সার্টিফিকেট আটকে ভর্তি বাণিজ্য নিশ্চিত করে। হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা। এর বাইরে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাজে বাধা দেয়া, থানায় ঢুকে আসামি ছিনিয়ে নেয়া, ওসিকে লাঞ্ছিত করা, আধিপত্য বিস্তার, বিলবোর্ড বাণিজ্য, গ্র“প-উপগ্র“পে বিভক্ত হয়ে সংঘর্ষ-মারামারিসহ বিভিন্ন নেতিবাচক ঘটনার জš§ দিচ্ছে নেতাকর্মীরা। সর্বশেষ মঙ্গলবারও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে কুমিল্লায় আবদুল আজিজ নামে এক শিবির কর্মী খুন হন। এর আগে সোমবার চট্টগ্রামে এক শিশুসহ ২ জন খুন হয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের গোলাগুলিতে। সংঘর্ষের জের ধরে ২২ জুন বন্ধ করে দিতে হয়েছে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এর আগে ১৬ জুন বন্ধ হয়ে যায় চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্রলীগ আর যুবলীগের এভাবে বেপরোয়া ও লাগামহীন হওয়ার প্রধান কারণ সরকারের মেয়াদ ৫ বছর পূর্ণ হতে আর দেরি নেই। তাই বেশির ভাগ নেতাকর্মী আখেরি ধান্ধায় নেমে পড়েছে। সারাদেশে যেসব দফতরের মাধ্যমে উন্নয়ন কাজ হচ্ছে, নিয়মিত মিছিল-মিটিং বা লেখাপড়া বাদ দিয়ে সেসব ভবনে সার্বক্ষণিক লেগে থাকছে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী। এরফলে ওইসব ভবনে আগে থেকে টেন্ডারবাজিতে লিপ্ত যুবলীগ বা অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাদের বিবাদ হচ্ছে। এই বিবাদ অবশ্য বেশির ভাগই অপ্রকাশিত থাকছে। কিন্তু দফারফা না হওয়ায় চট্টগ্রামে সোমবারের ঘটনা বন্দুকযুদ্ধের রূপ নেয়। সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, ছাত্রলীগ থেকে ইতিপূর্বে বিতাড়িত বা অবসর নেয়া বেশকিছু ব্যক্তির যুবলীগ বা অন্যান্য সহযোগী সংগঠনে পুনর্বাসিত হওয়াও প্রকাশ্য দ্বন্দ্বের কারণ। একযুগেরও বেশিদিন ধরে ঢাকার শিক্ষাভবন নিয়ন্ত্রণ করছেন ছাত্রলীগ থেকে একসময়ে বহিষ্কৃত নেতা শফিক। সম্প্রতি তিনি যুবলীগে একটি সম্পাদক পদ লাভে সক্ষম হন। শিক্ষাভবন-সচিবালয়-সেগুনবাগিচা এলাকায় ব্যাপক পোস্টারিং করে নিজের রাজনৈতিক পুনর্বাসনের বিষয়টি জানান দেন তিনি। এরপর থেকে শিক্ষাভবন, বিদ্যুৎভবন, পিডব্লিউডি, খাদ্যভবন এলাকায় তার মাস্তানি বেড়ে যায়। এমনকি তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের প্রভাবশালী সদস্যদের নাম পর্যন্ত ভাঙিয়ে থাকেন। এভাবে আরও বেশকিছু ব্যক্তি যুবলীগসহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠনে পাওয়া পদের অপব্যবহার করছেন। ফলে দুর্নাম হচ্ছে সরকার ও দলের। ঘটছে অঘটন।

পুলিশ ও ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সূত্র জানায়, একমাসে ছাত্রলীগ অন্তত অর্ধ-শতাধিক সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে। এরমধ্যে বড় ঘটনাটি ঘটেছে সোমবার চট্টগ্রামে। নগরীর কোতোয়ালি থানার সিআরবি এলাকায় সাত রাস্তার মোড়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের দেড় কোটি টাকার টেন্ডার দখলকে কেন্দ্র করে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের দু’গ্র“পের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে শিশুসহ দু’জন নিহত হন। নিহতরা হলেনÑ সাজু পালিত (২৮) এবং মোঃ আরমান হোসেন (৮)। আরমান স্থানীয় দরিদ্র রিকশাচালক মোঃ সিদ্দিকের ছেলে। জানা গেছে, ওই ঘটনায় যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও টেন্ডার কাজে ফোর স্টারখ্যাত হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক সাইফুল আলম লিমন গ্র“পের মধ্যে এ সংঘর্ষ বাধে। ঘটনার পর অবশ্য লিমনকে সংগঠন থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানান কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম। ঘটনার পর অভিযান চালিয়ে পুলিশ ৫২ জনকে আটক করে বলে জানা গেছে।

সোমবার দুপুরে চট্টগ্রামের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সন্ধ্যায় যুবলীগ-ছাত্রলীগ যৌথভাবে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে শিবিরের সঙ্গে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে পূর্বশত্র“তার জের ধরে শিবিরকর্মী আবদুল আজিজকে (২৫) পিটিয়ে হত্যা করা হয়। আজিজ উপজেলার আলকরা ইউনিয়নের দক্ষিণ সোনাইচ্ছা গ্রামের ইব্রাহিম মিয়ার ছেলে। সোমবার এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

এর আগে রোববার ক্লাস রুমে বসাকে কেন্দ্র করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম সিরাজুল ইসলাম গ্র“পের কর্মীদের মধ্যে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে। এতে অন্তত পাঁচজন আহত হয়। জবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এ ব্যাপারে বলেন, ছাত্রদল কর্মীদের উস্কানীতে জুনিয়র ছাত্রলীগ কর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮ জুন তিন সাংবাদিককে পেটায় ছাত্রলীগের কর্মীরা। ওই ঘটনায় তিনজনকে মৌখিকভাবে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেন সভাপতি এফএম শরীফুল ইসলাম।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে শিক্ষক আন্দোলনে অচল রয়েছে। এই আন্দোলনের কারণও ছাত্রলীগ। এক কর্মী একজন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করে। শিক্ষকরা এর বিচার চেয়ে না পেয়ে এখন তারা ক্যাম্পাসই অচল করে দিয়েছেন।

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি কার্যক্রম চলছে। ছাত্রলীগ কিশোর এই শিক্ষার্থীদের ভর্তি নিয়েও বাণিজ্যে মেতে ওঠে। রাজধানীর ঢাকা কলেজ, কবি নজরুল, বাঙলা কলেজ, তিতমীর কলেজসহ দেশের ২৭৭টি সরকারি কলেজের এই একই দশা। জানা গেছে, কলেজে তারা ভর্তির জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক আসন চেয়েছে। আবার কোনো কলেজে আসন নয়, প্রায় সব ভর্তিই তাদের মাধ্যমে করানোর বায়না ধরেছে। ঢাকা কলেজে ভর্তির জন্য ১০০ আসন দাবি করা হয়। এ নিয়ে তারা প্রশাসনকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। পাশাপাশি ক্যাম্পাসে একের পর এক মহড়াও দিচ্ছে ছাত্রলীগ। এমনকি গত বৃহস্পতিবার প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মহড়া ও ফাঁকা গুলি ছুড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও নিউমার্কেট থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমানের দাবি, কলেজে গুলির ঘটনা ঘটেনি। কবি নজরুল কলেজে প্রত্যেক ভর্তি থেকেই টাকা দাবি করা হচ্ছে। ভর্তিপ্রতি তারা ১৫-২০ হাজার টাকা দাবি করছে। ছাত্র সংসদের নেতা পরিচয়ে সোহেল, মামুন এবং অহিদ গ্র“পকে এই অর্থ দিতে হবে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ভর্তি বাণিজ্যের বাইরে সংঘর্ষের ঘটনা অহরহ।

২৩ জুনেই ছাত্রলীগের ইচ্ছা অনুসারে একাদশ শ্রেণীতে (অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে) শিক্ষার্থী ভর্তি না করায় নীলফামারী সরকারি কলেজে ভাঙচুর চালিয়েছে তারা। এতে পুরো কলেজে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সাময়িক সময়ের জন্য একাদশ শ্রেণীর ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। একইদিন সিলেট এমসি কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তির সিট ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের বিবদমান দুই গ্র“প অস্ত্রের মহড়া দিয়েছে। এ সময় ক্যাম্পাসে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। একই সময়ে পার্শ্ববর্তী সিলেট সরকারি কলেজে ছাত্রলীগের ভর্তি বাণিজ্য ও প্রশাসনের অনিয়মের বিরুদ্ধে মিছিল বিক্ষোভ করে ভাংচুর চালিয়েছে ছাত্রদল।

২২ জুন কুমিল্লার লাকসামে নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজে ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবির সংঘর্ষ হয়। এতে আহত হয় ১২ জন। জানা গেছে, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা শহরে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুর করে। এ ঘটনায় রোববার সকালে ছাত্রশিবির নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। ছাত্রলীগ কর্মীরাও বিকালে মিছিল বের করে। এরপরই বাধে সংঘর্ষ। সংঘর্ষ ও ভাংচুরের ঘটনায় লাকসাম থানায় পৃথক ২টি মামলা ও ১টি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। একইদিন পছন্দের শিক্ষার্থীদের ভর্তি না করায় সিলেট এমসি কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের অপেক্ষমাণ তালিকা ছিঁড়ে ফেলেছে ছাত্রলীগ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, এমসি কলেজ ছাত্রলীগের লুৎফুর, পলাশ, সৌরভ, আকাশ, রায়হান, কনকের নেতৃত্বে ১০ থেকে ১৫ জনের একটি গ্র“প নিজেদের পছন্দমাফিক ভর্তি করাতে চায়। প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ভর্তি কমিটির প্রধান শফিক নেওয়াজসহ শিক্ষকদের গালিগালাজ করে এবং দেয়ালে টানানো অপেক্ষামাণ তালিকাটি ছিঁড়ে ফেলে।

২২ জুনেই আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মধ্যে সংঘর্ষের পর পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবিপ্রবি) ২৫ জুন পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর আগে ১১ জুন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) ছাত্রলীগের দু’গ্র“পে সংঘর্ষের জের ধরে বিশ্ববিদ্যালয় সাতদিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। ওইদিন বিকাল ৩টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়। মূলত ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে এ ঘটনা ঘটে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র নায়েব আহত হয়।

গত ২০ জুন ছাত্রলীগের পদবঞ্চিত নেতাকর্মীদের হাতে প্রহƒত হন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ছাত্র জুয়েল মজুমদার। গায়ে রিকশার ধাক্কা দেয়ার অভিযোগ এনে চেতনা ’৭১-এর সামনে পদবঞ্চিত ছাত্রলীগ কর্মী সুলতানুল আলম সাইফ, শফিকুর রহমান শফিক, বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা আহসানুল হক বাবু ও মোস্তাকিম আহমেদ মোস্তাকের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ কর্মীরা এক রিকশাচালকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। এর প্রতিবাদ করায় তাকে মারধর করা হয়। একইদিন চট্টগ্রামে সড়ক অবরোধ করে গাড়ি ভাংচুর করেছে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনাসটিটিউট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বিকাল ৫টার দিকে পাঁচলাইশ থানার ষোলশহর দু’নম্বর গেট সড়ক অবরোধ করে তারা। এ সময় ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ। আটককৃত তিনজন হলÑ শহীদুল ইসলাম (২৬), অজয় দে (২৩) এবং আবু ফয়েজ (২৩)।

২০ জুন লক্ষ্মীপুর সদরের চন্দ্রগঞ্জ কফিল উদ্দিন ডিগ্রি কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি ‘ফি’ তিন হাজার টাকা নির্ধারণ করার প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করেছে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল। এ সময় তারা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করে ও ভর্তি ফি কমানোর দাবি জানায়। বৃহস্পতিবার দুপুরে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল যৌথভাবে এ হামলা চালায়।

১৯ জুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শোডাউন করে ছাত্রলীগ। পরে তারা সমাবেশ করে। নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মধ্যে সংঘর্ষে পুলিশসহ আহত হয়েছে অন্তত ২০ জন। ১৮ জুন একাদশ শ্রেণীতে অবৈধ ভর্তি বাণিজ্যের সুযোগ না পেয়ে কুমিল্লার লাকসামের নওয়াব ফয়েজুন্নেসা সরকারি কলেজের প্রশাসনিক ভবনের প্রধান ফটক ও ভর্তি নিয়ন্ত্রণ কক্ষে তালা লাগিয়ে দিয়েছে ছাত্রলীগ। ১১ জুন চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে রাজধানী গুলশান-২ সিটি কর্পোরেশনের একটি মার্কেটে ব্যাপক ভাংচুর করেছে মহানগর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। রাত ৭টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা ১৫-২০টি দোকান ভাংচুর ও লুটপাট করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য

সার্বিক ব্যাপারে জানতে চাইলে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সভাপতি এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ বলেন, দেশের যেখানেই ছাত্রলীগের নামে অঘটন ঘটছে, তার বেশির ভাগই ব্যক্তিগত স্খলন; দলীয় নয়। আসলে ছাত্রলীগ নামধারী কিছু সন্ত্রাসীর কারণে ৬৪ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনের সুনাম নষ্ট হতে পারে না। সন্ত্রাসী বা অপরাধী যেই হোক, তার নিস্তার নেই। তিনি বলেন, যখনই কোনো নেতিবাচক ঘটনা ঘটে, তখনই অ্যাকশন চালানো হয়। প্রথমে সাময়িক বহিষ্কার করে পরে ঘটনা তদন্ত করে প্রয়োজনে আজীবন বহিষ্কারের রেকর্ড রয়েছে। তিনি আরও বলেন, তারা দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা মোকাবেলা করেন। সেই ঘটনায় বাণিজ্যের চেষ্টার অভিযোগে কবি নজরুল কলেজের কমিটি ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও বিভিন্ন স্থানে কমিটি ভেঙে দেয়ার ঘটনা রয়েছে। এছাড়া ব্যক্তিগত স্খলনের দায় না নিয়ে সাতক্ষীরা জেলা ও পিরোজপুর জেলা কমিটি ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। সুতরাং তারা এ বার্তা দিতে চাচ্ছেন যে, ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে কোনো অপরাধ করলে তা বরদাস্ত করা হবে না।

সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম বলেন, ছাত্রলীগ কোনো সন্ত্রাসী বা অপরাধীর জায়গা নয়। তাদের দায় ছাত্রলীগ নেয় না, নেবেও না। সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ যারা করেছে তাদের সংগঠন থেকে ইতিমধ্যে বের করে দেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতেও তাড়িয়ে দেয়া হবে। যারা অপরাধী তাদের ছাত্রলীগ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে ও সাংগঠনিক শাস্তি দেয়া হয়েছে। দেশের প্রচলিত আইনে ওইসব অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার লক্ষ্যে গ্রেফতারের দায়িত্ব আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর। এখন তারা (আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী) যদি তাদের দায়িত্ব পালন না করে সেক্ষেত্রে ক্ষোভ প্রকাশ ছাড়া কিছুই করার নেই। আর এক্ষেত্রে অপরাধীরাও সাহস পেয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, যেহেতু অপরাধীরা বহিষ্কৃত, তাই তারা ছাত্রলীগের কেউ নয়। অপরাধীকে ধরলে ছাত্রলীগের কোনো পর্যায় থেকে তদবির করা হবে না।


 

 
শনি
রোব
সোম
মঙ্গল
বুধ
বৃহ
শুক্র