jugantor
রাবিতে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা গুলি
বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকাল বন্ধ সকাল ৮টার মধ্যে হলত্যাগের নির্দেশ

  রাজশাহী ব্যুরো  

০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ০০:০০:০০  | 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ধিত ফি ও সান্ধ্যকোর্স বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। এ সময় তারা শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে কয়েক দফা ককটেল বিস্ফোরণ ও গুলি ছোড়ে। পরে ছাত্রলীগের সঙ্গে যোগ দিয়ে পুলিশও শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে কয়েকশ’ রাউন্ড রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল ছোড়ে। গুলি চালানো হয়েছে সাংবাদিকদের ওপরও। রোববার দিনভর দফায় দফায় এ সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় গোটা ক্যাম্পাস রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এতে অন্তত ৩০ জন গুলিবিদ্ধসহ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। পুলিশ ও র‌্যাবের পাশাপাশি ক্যাম্পাসে দুই প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সন্ধ্যায় সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকাল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সেইসঙ্গে আজ সোমবার সকাল ৮টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ঘটনা তদন্তে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর খালেকুজ্জামানকে প্রধান করে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা এ হামলার ঘটনাকে প্রশাসনের পরিকল্পিত আখ্যায়িত করে বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হলেও আন্দোলন চলবে। এদিকে সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের গুলির ঘটনায় তিন সহকারী প্রক্টরকে অপসারণ ও রাজশাহী মহানগর পুলিশের উপকমিশনার প্রলয় চিচিমকে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিকরা।

ক্যাম্পাস সূত্র জানায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের তৃতীয় দিনের ধর্মঘটের শুরুতে সকালে শিক্ষার্থীদের মিছিলে বাধা দেয় পুলিশ। বাধা উপেক্ষা করে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ক্যাম্পাসে মিছিল বের করে শিক্ষার্থীরা। মিছিল শেষে প্রশাসন ভবন ঘেরাও করে সমাবেশ শুরু করেন তারা। কিছুক্ষণ পর সমাবেশের পাশে দুটি ককটেল বিম্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ সময় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লেও শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দলীয় টেন্ট থেকে মিছিল বের করে ছাত্রলীগ নেতাকর্র্মীরা। মিছিলটি ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে একপর্যায়ে সমাবেশের ভিতর ঢুকে যায়। এ সময় বসে থাকা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা উঠে গিয়ে ছাত্রলীগের মিছিল পার হতে জায়গা করে দেয়। মিছিলটি সমাবেশস্থল অতিক্রম করে কিছুদূর যাওয়ার পরই হঠাৎ পেছনে ঘুরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেয়। তারা শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে প্রথমে দুটি ককটেলের বিম্ফোরণ ঘটায় এবং পরে গুলি ছোড়ে। এ সময় ছাত্রলীগের সাবেক কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুদীপ্ত সালাম, সহ-সভাপতি নাসিম আহমেদ সেতু, বর্তমান কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মুস্তাকিম বিল্লাহ, সহ-সভাপতি ফয়সাল আহম্মেদ রুনু ও ছাত্রলীগ নেতা ইমনকে পিস্তল উঁচিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। একই সঙ্গে সমাবেশের পাশে লিচুতলায় আগে থেকে অবস্থিত পুলিশ সদস্যরা শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল ছোড়ে। দ্বিমুখী এ আক্রমণে শিক্ষার্থীরা দিগি¦দিক ছোটাছুটি শুরু করে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের লিচুতলা, শহীদুল্লাহ কলাভবন ও পুরাতন ফোকলোর চত্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের বেধড়ক মারধর করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ইটপাটকেল ছুড়ে এর জবাব দেয়ার চেষ্টা চালায়। পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলায় অন্তত ২৫ জন গুলিবিদ্ধ ও অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। গুরুতর আহতদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ নগরীর বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে।

হামলায় ছত্রভঙ্গ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারসহ বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নেয়। এ সময় বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মী কেন্দ ীয় গ্রন্থাগারের সামনে ও টুকিটাকি চত্বরে অবস্থান নেয়। ছাত্রলীগ নেতকর্র্মীরা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার লক্ষ্য করে গুলি ও ইটপাটকেল ছোড়ে। কিছুক্ষণ পর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা রবীন্দ কলাভবনের দিকে সরে যায়। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের ভেতরে আটকে পড়া শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিতে থাকেন। কিছুক্ষণ পরপর ভেতরে আটকে পড়া আহত শিক্ষার্থীদের বাইরে বের করে আনা হয়। এ সময় আহত শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে নেয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স চাওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ থেকে কোনো অ্যাম্বুলেন্স দেয়া হয়নি।

অন্যদিকে ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বেলা ১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলের শিক্ষার্থীরা মাদার বখশ হলের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এ সময় ছাত্রলীগ ও পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর আবারও হামলা চালায়। শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে শহীদ সোহরওয়ার্দী ও মাদার বখশ হলের ভেতর ঢুকে যায়। এ সময় হল দুটি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে পুলিশ। এতেও কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন। একপর্যায়ে পুলিশ হলে ঢুকে শিক্ষার্থীদের বেধড়ক লাঠিপেটা করে। আহতদের মধ্যে রয়েছেন- অমিত গোস্বামী, তারিন, স্বপন, রাজিব, তাওহিদ, বিলকিস নাহার, আতিক, শোভন, সালমা, মায়া, আশুরা, রবিউল, পরাগ, আশিক, রাখি, সাজু, আবদুর রশিদ, যুথি, সুফিয়ান ও তৌহিদ।

বেলা ২টার দিকে বিভিন্ন আবাসিক হল থেকে শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বিজ্ঞান ভবনের সামনে থেকে মিছিল বের করে। মিছিলটি ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ ীয় গ্রন্থাগারের সামনে এসে জড়ো হয়। এ সময় পুলিশ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে বিকাল তিনটার দিকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থান থেকে শিক্ষার্থীরা কেন্দ ীয় গ্রন্থাগারের সামনের রাস্তায় জড়ো হয়ে সমাবেশ করেন।

এদিকে বেলা দেড়টার দিকে আন্দোলনে সমর্থনকারী কয়েকজন শিক্ষক কেন্দ ীয় গ্রন্থাগারের সামনে এসে ভেতরে অবস্থানকারী উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। পরে তারা সেখানে প্রেস ব্রিফিং করে হামলার নিন্দা জানান। তারা বলেন, ‘চলমান শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের গুণ্ডা ও পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে প্রশাসন আন্দোলন নস্যাৎ করতে চাচ্ছে। শিক্ষকরা হলেন- নৃবিজ্ঞান বিভাগের বখতিয়ার আহমেদ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের কাজী মামুন হায়দার রানা, ফোকলোর বিভাগের সুস্মিতা চক্রবর্র্তী এবং পরিসংখ্যান বিভাগের আবু নাসের।

এর আগে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কেন্দ ীয় গ্রন্থাগারের সামনে সাংবাদিকরা হামলার প্রতিবাদ ও অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহারের দাবি জানালে রাজশাহী মহানগর পুলিশের উপকমিশনার প্রলয় চিচিম এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ সময় সাংবাদিকদের দিকে তেড়ে এসে রাবি সাংবাদিক সমিতির সভাপতি শাকির আহমেদের বুকে শটগান ঠেকিয়ে গুলি করার হুমকি দেয় পুলিশ। একপর্যায়ে কয়েকজন পুলিশ সদস্য সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ছোড়ে। এতে নিউএইজের রাবি প্রতিনিধি নাজিম মাহমুদ, মাছারাঙা টেলিভিশনের রাজশাহী প্রতিনিধি গোলাম রব্বানী, মানবকণ্ঠের বুলবুল আহমেদ ফাহিম, ফ্লাশ নিউজের সজীব ও আলী রমজান, শীর্ষ নিউজের জাকির হোসেন তমাল, ফটোসাংবাদিক গুলবার আলী জুয়েল ও শামস রুমী আহত হন। এর প্রতিবাদে সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত সহকারী প্রক্টর সিরাজুল ইসলাম, সাখওয়াত হোসেন, হেলাল উদ্দিনকে অপসারণ ও পুলিশ উপকমিশনার প্রলয় চিচিমকে প্রত্যাহারের দাবি জানান।

শিক্ষার্থীদের কঠোর আন্দোলনের মুখে শনিবার বর্ধিত ফি বাস্তবায়ন স্থগিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে সান্ধ্যকোর্স বন্ধসহ শিক্ষার্থীদের দাবি পুরোপুরি মেনে না নেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা অব্যাহত রাখে শিক্ষার্থীরা।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বহিরাগত ও শিবির যোগ দিয়ে গোটা ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রশাসনের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছিল।

রাবি ছাত্রলীগের সভাপতি মিজানুর রহমান রানা বলেন, কয়েক দিন ধরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে ছাত্রশিবিরের সন্ত্রাসীরা ঢুকে ক্যাম্পাসে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির চেষ্টা করেছিল। রোববার আমাদের শান্তিপূর্ণ বিজয় মিছিলের পেছন থেকে শিবির ক্যাডাররা বোমা হামলা চালায়। এতে আমিসহ ১৫-১৮ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছি। বোমা হামলায় তার শরীরের ১৫-২০টি স্থানে স্পি­ন্টার লেগেছে বলে দাবি করে রানা আরও জানান, সহ-সভাপতি রানা ও যুগ্ম সম্পাদক পলাশের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

মহানগর পুলিশের উপকমিশনার প্রলয় চিচিম বলেন, কয়েকদিন ধরে আন্দোলন চলছিল। আজ (রোববার) সমাবেশ চলাকালে একটি মিছিল আসে। পরে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ অ্যাকশনে যায়।


 

সাবমিট

রাবিতে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা গুলি

বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকাল বন্ধ সকাল ৮টার মধ্যে হলত্যাগের নির্দেশ
 রাজশাহী ব্যুরো 
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ১২:০০ এএম  | 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ধিত ফি ও সান্ধ্যকোর্স বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। এ সময় তারা শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে কয়েক দফা ককটেল বিস্ফোরণ ও গুলি ছোড়ে। পরে ছাত্রলীগের সঙ্গে যোগ দিয়ে পুলিশও শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে কয়েকশ’ রাউন্ড রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল ছোড়ে। গুলি চালানো হয়েছে সাংবাদিকদের ওপরও। রোববার দিনভর দফায় দফায় এ সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় গোটা ক্যাম্পাস রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এতে অন্তত ৩০ জন গুলিবিদ্ধসহ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। পুলিশ ও র‌্যাবের পাশাপাশি ক্যাম্পাসে দুই প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সন্ধ্যায় সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকাল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সেইসঙ্গে আজ সোমবার সকাল ৮টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ঘটনা তদন্তে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর খালেকুজ্জামানকে প্রধান করে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা এ হামলার ঘটনাকে প্রশাসনের পরিকল্পিত আখ্যায়িত করে বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হলেও আন্দোলন চলবে। এদিকে সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের গুলির ঘটনায় তিন সহকারী প্রক্টরকে অপসারণ ও রাজশাহী মহানগর পুলিশের উপকমিশনার প্রলয় চিচিমকে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিকরা।

ক্যাম্পাস সূত্র জানায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের তৃতীয় দিনের ধর্মঘটের শুরুতে সকালে শিক্ষার্থীদের মিছিলে বাধা দেয় পুলিশ। বাধা উপেক্ষা করে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ক্যাম্পাসে মিছিল বের করে শিক্ষার্থীরা। মিছিল শেষে প্রশাসন ভবন ঘেরাও করে সমাবেশ শুরু করেন তারা। কিছুক্ষণ পর সমাবেশের পাশে দুটি ককটেল বিম্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ সময় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লেও শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দলীয় টেন্ট থেকে মিছিল বের করে ছাত্রলীগ নেতাকর্র্মীরা। মিছিলটি ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে একপর্যায়ে সমাবেশের ভিতর ঢুকে যায়। এ সময় বসে থাকা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা উঠে গিয়ে ছাত্রলীগের মিছিল পার হতে জায়গা করে দেয়। মিছিলটি সমাবেশস্থল অতিক্রম করে কিছুদূর যাওয়ার পরই হঠাৎ পেছনে ঘুরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেয়। তারা শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে প্রথমে দুটি ককটেলের বিম্ফোরণ ঘটায় এবং পরে গুলি ছোড়ে। এ সময় ছাত্রলীগের সাবেক কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুদীপ্ত সালাম, সহ-সভাপতি নাসিম আহমেদ সেতু, বর্তমান কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মুস্তাকিম বিল্লাহ, সহ-সভাপতি ফয়সাল আহম্মেদ রুনু ও ছাত্রলীগ নেতা ইমনকে পিস্তল উঁচিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। একই সঙ্গে সমাবেশের পাশে লিচুতলায় আগে থেকে অবস্থিত পুলিশ সদস্যরা শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল ছোড়ে। দ্বিমুখী এ আক্রমণে শিক্ষার্থীরা দিগি¦দিক ছোটাছুটি শুরু করে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের লিচুতলা, শহীদুল্লাহ কলাভবন ও পুরাতন ফোকলোর চত্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের বেধড়ক মারধর করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ইটপাটকেল ছুড়ে এর জবাব দেয়ার চেষ্টা চালায়। পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলায় অন্তত ২৫ জন গুলিবিদ্ধ ও অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। গুরুতর আহতদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ নগরীর বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে।

হামলায় ছত্রভঙ্গ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারসহ বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নেয়। এ সময় বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মী কেন্দ ীয় গ্রন্থাগারের সামনে ও টুকিটাকি চত্বরে অবস্থান নেয়। ছাত্রলীগ নেতকর্র্মীরা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার লক্ষ্য করে গুলি ও ইটপাটকেল ছোড়ে। কিছুক্ষণ পর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা রবীন্দ কলাভবনের দিকে সরে যায়। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের ভেতরে আটকে পড়া শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিতে থাকেন। কিছুক্ষণ পরপর ভেতরে আটকে পড়া আহত শিক্ষার্থীদের বাইরে বের করে আনা হয়। এ সময় আহত শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে নেয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স চাওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ থেকে কোনো অ্যাম্বুলেন্স দেয়া হয়নি।

অন্যদিকে ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বেলা ১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলের শিক্ষার্থীরা মাদার বখশ হলের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এ সময় ছাত্রলীগ ও পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর আবারও হামলা চালায়। শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে শহীদ সোহরওয়ার্দী ও মাদার বখশ হলের ভেতর ঢুকে যায়। এ সময় হল দুটি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে পুলিশ। এতেও কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন। একপর্যায়ে পুলিশ হলে ঢুকে শিক্ষার্থীদের বেধড়ক লাঠিপেটা করে। আহতদের মধ্যে রয়েছেন- অমিত গোস্বামী, তারিন, স্বপন, রাজিব, তাওহিদ, বিলকিস নাহার, আতিক, শোভন, সালমা, মায়া, আশুরা, রবিউল, পরাগ, আশিক, রাখি, সাজু, আবদুর রশিদ, যুথি, সুফিয়ান ও তৌহিদ।

বেলা ২টার দিকে বিভিন্ন আবাসিক হল থেকে শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বিজ্ঞান ভবনের সামনে থেকে মিছিল বের করে। মিছিলটি ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ ীয় গ্রন্থাগারের সামনে এসে জড়ো হয়। এ সময় পুলিশ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে বিকাল তিনটার দিকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থান থেকে শিক্ষার্থীরা কেন্দ ীয় গ্রন্থাগারের সামনের রাস্তায় জড়ো হয়ে সমাবেশ করেন।

এদিকে বেলা দেড়টার দিকে আন্দোলনে সমর্থনকারী কয়েকজন শিক্ষক কেন্দ ীয় গ্রন্থাগারের সামনে এসে ভেতরে অবস্থানকারী উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। পরে তারা সেখানে প্রেস ব্রিফিং করে হামলার নিন্দা জানান। তারা বলেন, ‘চলমান শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের গুণ্ডা ও পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে প্রশাসন আন্দোলন নস্যাৎ করতে চাচ্ছে। শিক্ষকরা হলেন- নৃবিজ্ঞান বিভাগের বখতিয়ার আহমেদ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের কাজী মামুন হায়দার রানা, ফোকলোর বিভাগের সুস্মিতা চক্রবর্র্তী এবং পরিসংখ্যান বিভাগের আবু নাসের।

এর আগে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কেন্দ ীয় গ্রন্থাগারের সামনে সাংবাদিকরা হামলার প্রতিবাদ ও অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহারের দাবি জানালে রাজশাহী মহানগর পুলিশের উপকমিশনার প্রলয় চিচিম এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ সময় সাংবাদিকদের দিকে তেড়ে এসে রাবি সাংবাদিক সমিতির সভাপতি শাকির আহমেদের বুকে শটগান ঠেকিয়ে গুলি করার হুমকি দেয় পুলিশ। একপর্যায়ে কয়েকজন পুলিশ সদস্য সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ছোড়ে। এতে নিউএইজের রাবি প্রতিনিধি নাজিম মাহমুদ, মাছারাঙা টেলিভিশনের রাজশাহী প্রতিনিধি গোলাম রব্বানী, মানবকণ্ঠের বুলবুল আহমেদ ফাহিম, ফ্লাশ নিউজের সজীব ও আলী রমজান, শীর্ষ নিউজের জাকির হোসেন তমাল, ফটোসাংবাদিক গুলবার আলী জুয়েল ও শামস রুমী আহত হন। এর প্রতিবাদে সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত সহকারী প্রক্টর সিরাজুল ইসলাম, সাখওয়াত হোসেন, হেলাল উদ্দিনকে অপসারণ ও পুলিশ উপকমিশনার প্রলয় চিচিমকে প্রত্যাহারের দাবি জানান।

শিক্ষার্থীদের কঠোর আন্দোলনের মুখে শনিবার বর্ধিত ফি বাস্তবায়ন স্থগিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে সান্ধ্যকোর্স বন্ধসহ শিক্ষার্থীদের দাবি পুরোপুরি মেনে না নেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা অব্যাহত রাখে শিক্ষার্থীরা।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বহিরাগত ও শিবির যোগ দিয়ে গোটা ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রশাসনের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছিল।

রাবি ছাত্রলীগের সভাপতি মিজানুর রহমান রানা বলেন, কয়েক দিন ধরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে ছাত্রশিবিরের সন্ত্রাসীরা ঢুকে ক্যাম্পাসে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির চেষ্টা করেছিল। রোববার আমাদের শান্তিপূর্ণ বিজয় মিছিলের পেছন থেকে শিবির ক্যাডাররা বোমা হামলা চালায়। এতে আমিসহ ১৫-১৮ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছি। বোমা হামলায় তার শরীরের ১৫-২০টি স্থানে স্পি­ন্টার লেগেছে বলে দাবি করে রানা আরও জানান, সহ-সভাপতি রানা ও যুগ্ম সম্পাদক পলাশের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

মহানগর পুলিশের উপকমিশনার প্রলয় চিচিম বলেন, কয়েকদিন ধরে আন্দোলন চলছিল। আজ (রোববার) সমাবেশ চলাকালে একটি মিছিল আসে। পরে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ অ্যাকশনে যায়।


 

 
শনি
রোব
সোম
মঙ্গল
বুধ
বৃহ
শুক্র