jugantor
ছাত্রলীগের ‘টর্চার সেল’ আবুসিনা ছাত্রাবাস
ওসমানী মেডিকেল কলেজে চাঁদা না দিলে চলে অমানুষিক নির্যাতন

  রেজওয়ান আহমদ, সিলেট থেকে  

১০ জুন ২০১৪, ০০:০০:০০  | 

এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ। মানসম্পন্ন চিকিৎসক গড়ার সিলেট বিভাগের একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান। কলেজের ছাত্রাবাস চারটি। দুটি ছাত্রীনিবাস। ছাত্রাবাসগুলোর দুটি ক্যাম্পাসের বাইরে। এর মধ্যে আবুসিনা একটি। নগরীর চৌহাট্টা-মেডিকেল ভিআইপি রোডের পাশেই এর অবস্থান। আবুসিনার চার ব্লকে রয়েছে ৩৯ কক্ষ। প্রথম ব্লকেই ১০০৩। ক্ষমতার পালাবদলে এখন তা ছাত্রলীগ ক্যাডারদের দখলে। ২০০৯ সালের আগে কক্ষটি দীর্ঘদিন দখলে ছিল ছাত্রদলের। ৪ জুন এখানেই পিটিয়ে হত্যা করা হয় ছাত্রদল নেতা তাওহীদকে।

কলেজ শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি সৌমেন দে রোববার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দেন। জানান হত্যার সঙ্গে জড়িতদের নাম। তার স্বীকারোক্তিতেই বেরিয়ে আসে ১০০৩ নম্বর কক্ষ ছিল ছাত্রলীগের ‘টর্চার সেল’। বিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী ও টার্গেট ছাত্রদের কাছে চাঁদা না পেলে এ টর্চার সেলে এনেই চলত নির্মম নির্যাতন। মাদক সেবনের আস্তানা আর ছাত্রলীগের অস্ত্রাগারও ছিল কক্ষটি।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সৌমেন দে বলেন, তাওহীদের কাছে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিল ছাত্রলীগ। এ টাকা না দেয়ায় টর্চার সেলে নিয়ে পিটিয়ে খুন করা হয় তাওহীদকে। এর আগেও বহু ছাত্র এ কক্ষে শিকার হয়েছেন নির্মম নির্যাতনের।

সোমবার বিকালে আবুসিনা ছাত্রাবাসে গিয়ে দেখা যায় পিনপতন নীরবতা। হলের গেটে পাহারা দিচ্ছেন ৬-৭ পুলিশ সদস্য। পুরো হল ঘুরে দেখা যায়, হলের সব কটি কক্ষ তালাবদ্ধ। বেশ কটি রুমের ভেতর লাইট জ্বলছে, ফ্যান চলছে। যেসব কক্ষের জানালা খোলা, উঁকি দিলেই দেখা যায়, সেগুলোর ভেতরে বিছানা ও কাপড়-চোপড় এলোমেলো। বারান্দায় ছাত্রদের কাপড় টানানো। শুকানোর জন্য টানানো হয়েছিল সেসব।

১০০৩ তালাবদ্ধ। কিন্তু জানালা খোলা। জানালা দিয়ে দেখা যায়, ভেতরে চারটি কাঠের বিছানা। এলোমেলো। আলনার কাপড়গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। রুমের এক কোনায় একটি বাইসাইকেল। প্রতিবেদককে দেখে দৌড়ে আসেন হোস্টেলের এমএলএসএস (পিয়ন) মনির ও রশিদ। তারা জানান, ঘটনার পর হলের সব ছাত্র তাড়াহুড়ো করে সটকে পড়ে। তাই এ অবস্থা।

হলের পাশে মেডিকেলের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের কলোনি। ‘সাংবাদিক’ শোনার পর এ কলোনির লোকজন অনেকেই বন্ধ করে দেন ঘরের দরজা। যে দু-একজন কথা বলেছেন, গোপন রেখেছেন পরিচয়। তাদের মধ্যেও অজানা আতংক।

একাধিক ব্যক্তি জানান, ঘটনার দিন হলে ডিউটিতে ছিলেন এমএলএসএস রশিদ। ১০০৩নং কক্ষে যখন তাওহীদকে নির্যাতন করছিল ছাত্রলীগ ক্যাডাররা, রশিদ তখন গেটে তালা দিয়ে পাহারা দিচ্ছিল। তাওহীদের চিৎকার শুনে অনেকেই এগিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু রশীদ তাদের তাড়িয়ে দেন। তারা জানায়, ছাত্রলীগ ক্যাডারদের সব অপকর্মের সহযোগী হচ্ছে এই রশীদ। অথচ পুলিশ প্রহরায় রশীদ ডিউটি করছে, তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। তাদের দাবি, রশীদকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ছাত্রলীগের টর্চার সেলের অনেক লোমহর্ষক ঘটনা উদ্ঘাটন হবে।

টর্চার সেল ১০০৩ : অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ কক্ষটি ছাত্ররাজনীতির নামে দুর্বৃত্তায়নের নীরব এক সাক্ষী। নিয়মিত মদ, গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবাসেবীদের আড্ডা বসত এখানে। এ আসরের খরচ জোগানো, আমোদফুর্তি ও নানা ‘প্রয়োজন’ মেটানোর জন্য মেডিকেল ছাত্রদের এখানেই টর্চার করে চাঁদা আদায় করা হতো। আর তা করা হতো নিয়মিত। পাশাপাশি কক্ষটি ‘রিমান্ড’ সেলও ছিল ছাত্রলীগের। এছাড়া কক্ষটি ব্যবহার হতো লাঠিসোটা, দা, কিরিচ, হকিস্টিক ও আগ্নেয়াস্ত্র রাখার ‘মালখানা’ হিসেবে।

টর্চার সেলে নির্যাতিত যারা : তাওহীদকে খুনের আগে এ কক্ষে আরও অনেক ছাত্রদল নেতাকর্মী ও সাধারণ নিরীহ ছাত্রদের ‘রিমান্ডে’ এনে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। এদের একজন মেডিকেল ছাত্রদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আশিকুর রহমান আশিক। তাকে ধরে নেয়া হয়েছিল সামসুদ্দিন ছাত্রাবাস থেকে। এ নিয়ে ছাত্রলীগ-ছাত্রদল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে সমঝোতায় সমাধান হয়। তার আগে ছাত্রদল কর্মী সাদ্দামকে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। এছাড়া নির্যাতনের শিকার অনেকেই এখন আর ভয়ে এ নিয়ে কোনো কথাও বলতে চান না।

ভুলুণ্ঠিত অতীত : মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ছিলেন বঙ্গবীর এমএজি ওসমানী। এই বীর সন্তানের জন্মস্থান সিলেট। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তার নামেই করা হয়েছিল এ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নামকরণ। সত্তরের দশকে প্রতিষ্ঠিত এ দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সিলেট বিভাগের একমাত্র সরকারি মেডিকেল কলেজ এখন এটি আর হাসপাতালটি সর্ববৃহৎ সরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান। কলেজের ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাসগুলোর অধিকাংশেরই নামকরণও করা হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নামে।

এ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল যোগ্য চিকিৎসক গড়ে তোলা- যাতে তারা মানবসেবায় অবদান রাখতে পারেন। আর মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্তদের নামকরণে ছিল দেশপ্রেমের মহিমা ও ত্যাগের শিক্ষা।

কিন্তু সে অতীত ও শিক্ষা আজ ভুলুণ্ঠিতপ্রায়। দীর্ঘদিন ধরে কলেজ ও হাসপাতাল জিম্মি রাজনীতি আর ছাত্র রাজনীতির কাছে। গুটিকয়েক দুর্বৃত্ত ও ক্যাডার জিম্মি করে রেখেছে এ দুই প্রতিষ্ঠানকে। ক্ষমতার পালাবদলে বদলে যায় এর নিয়ন্ত্রকদের তালিকাও। সেই ধারাবাহিকতায় হাসপাতাল, কলেজ ছাড়াও সব ক’টি ছাত্রাবাস, ছাত্রীনিবাস এখন শাসক দলের ক্যাডারদের দখলে। আবাসিক হলগুলো ছাত্রলীগ ক্যাডারদের রামরাজ্য। হলের মধ্যেই রয়েছে সংগঠনের কার্যালয়। প্রতিটি হলেই রয়েছে অঘোষিত টর্চার সেল।

টর্চার সেলেই খুন! : তাওহীদকে অজ্ঞান অবস্থায় নয়, খুন করার পরই মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জরুরি বিভাগ ও সিসিইউতে চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল মৃত তাওহীদকে। মহানগর বিএনপির সভাপতি এমএ হকসহ ছাত্রদলের অনেকেই এমন দাবি করছেন জোর গলায়। তারা বলছেন, টর্চার সেলে খুনের বিষয়টি আড়াল করতেই হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসার নাটক সাজানো হয়েছে।

টর্চার সেলের নিয়ন্ত্রক : আবুসিনা ছাত্রাবাসের টর্চার সেলের নিয়ন্ত্রক ছিলেন ছাত্রলীগের কয়েক ক্যাডার। এর মধ্যে মোস্তাফিজুর রহমান রাফির নাম রয়েছে শীর্ষে। তিনি আবুসিনা ছাত্রাবাস ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তাওহীদকে খুনের সময় পর্যায়ক্রমে অনেকেই গিয়েছিল সেই সেলে। এর আংশিক বর্ণনা উঠে এসেছে সৌমেন দে’র জবানবন্দিতেও। এ টর্চার সেলের কথা জানত মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। জানত পুলিশও। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপই নেয়া যায়নি। কারণ তারা শাসক দলের ক্যাডার। নগরীর অনেক প্রভাবশালী ক্ষমতাধর ওদের লালন করে।

এজাহারে যাদের নাম : তাওহীদের চাচা আনোয়ার হোসেন বাদী হয়ে কোতোয়ালি মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের ১০ নেতাকর্মীর নাম রয়েছে ঘাতক হিসেবে। তারা হচ্ছেন, মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি সৌমেন দে, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হাই, রাফি, ফাহিম, জুবায়ের, শরীফ, অন্তর, হাফিজ, পাঠান ও আশিষ। কোতোয়ালি মডেল থানার এসআই সিরাজুল ইসলাম মামলাটি তদন্ত করছেন। সৌমেন দে ছাড়া আর কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।

তাওহীদের পরিচয় : তাওহীদ সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চতুর্থ বর্ষের ৪৯তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। তিনি ছিলেন ছাত্রদল মেডিকেল কলেজ শাখার আপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক। বাড়ি শরীয়তপুর জেলার জাজিরা এলাকায়। পিতা শামসুর রহমান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। মা ও বোনকে নিয়ে নগরীর কাজলশাহ এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। বোন নাহার বেগম সিলেট সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী।

বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল : তাওহীদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে খুনের পর বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল। সৌমেনের জবানবন্দিতে বেরিয়ে এসেছে এসব। ছাত্রলীগ ক্যাডারের গডফাদারদের নাম চলে আসায় আদালত ও পুলিশ প্রশাসনে চরম গোপনীয়তার আশ্রয় নেয়া হচ্ছে। দাবি করা হচ্ছে, তদন্তের স্বার্থেই গোপনীয়তা। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সৌমেনের জবানবন্দিতে অনেক রাঘব বোয়ালের নাম উঠে এসেছে- যারা ছাত্ররাজনীতিতে সুযোগ করে দেয়ার নামে এসব অপরাধ, অপকর্মের প্রশ্রয় দিয়ে আসছিল ক্যাডারদের। যাদের দেখলে সালাম ঠুকতে হয় প্রশাসনের।

বুধবার সন্ধ্যায় আবুসিনা ছাত্রাবাসের ১০০৩নং কক্ষে ডেকে নিয়ে তাওহীদুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটায়। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় ওসমানী হাসপাতালে নেয়ার পর তাওহীদ মারা যান। কলেজ কর্তৃপক্ষ একাডেমিক কাউন্সিলের জরুরি সভা করে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে এবং হত্যা মামলার এজাহার নামীয় ১০ ছাত্রকে সাময়িক বহিষ্কার করে।


 

সাবমিট

ছাত্রলীগের ‘টর্চার সেল’ আবুসিনা ছাত্রাবাস

ওসমানী মেডিকেল কলেজে চাঁদা না দিলে চলে অমানুষিক নির্যাতন
 রেজওয়ান আহমদ, সিলেট থেকে 
১০ জুন ২০১৪, ১২:০০ এএম  | 

এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ। মানসম্পন্ন চিকিৎসক গড়ার সিলেট বিভাগের একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান। কলেজের ছাত্রাবাস চারটি। দুটি ছাত্রীনিবাস। ছাত্রাবাসগুলোর দুটি ক্যাম্পাসের বাইরে। এর মধ্যে আবুসিনা একটি। নগরীর চৌহাট্টা-মেডিকেল ভিআইপি রোডের পাশেই এর অবস্থান। আবুসিনার চার ব্লকে রয়েছে ৩৯ কক্ষ। প্রথম ব্লকেই ১০০৩। ক্ষমতার পালাবদলে এখন তা ছাত্রলীগ ক্যাডারদের দখলে। ২০০৯ সালের আগে কক্ষটি দীর্ঘদিন দখলে ছিল ছাত্রদলের। ৪ জুন এখানেই পিটিয়ে হত্যা করা হয় ছাত্রদল নেতা তাওহীদকে।

কলেজ শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি সৌমেন দে রোববার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দেন। জানান হত্যার সঙ্গে জড়িতদের নাম। তার স্বীকারোক্তিতেই বেরিয়ে আসে ১০০৩ নম্বর কক্ষ ছিল ছাত্রলীগের ‘টর্চার সেল’। বিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী ও টার্গেট ছাত্রদের কাছে চাঁদা না পেলে এ টর্চার সেলে এনেই চলত নির্মম নির্যাতন। মাদক সেবনের আস্তানা আর ছাত্রলীগের অস্ত্রাগারও ছিল কক্ষটি।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সৌমেন দে বলেন, তাওহীদের কাছে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিল ছাত্রলীগ। এ টাকা না দেয়ায় টর্চার সেলে নিয়ে পিটিয়ে খুন করা হয় তাওহীদকে। এর আগেও বহু ছাত্র এ কক্ষে শিকার হয়েছেন নির্মম নির্যাতনের।

সোমবার বিকালে আবুসিনা ছাত্রাবাসে গিয়ে দেখা যায় পিনপতন নীরবতা। হলের গেটে পাহারা দিচ্ছেন ৬-৭ পুলিশ সদস্য। পুরো হল ঘুরে দেখা যায়, হলের সব কটি কক্ষ তালাবদ্ধ। বেশ কটি রুমের ভেতর লাইট জ্বলছে, ফ্যান চলছে। যেসব কক্ষের জানালা খোলা, উঁকি দিলেই দেখা যায়, সেগুলোর ভেতরে বিছানা ও কাপড়-চোপড় এলোমেলো। বারান্দায় ছাত্রদের কাপড় টানানো। শুকানোর জন্য টানানো হয়েছিল সেসব।

১০০৩ তালাবদ্ধ। কিন্তু জানালা খোলা। জানালা দিয়ে দেখা যায়, ভেতরে চারটি কাঠের বিছানা। এলোমেলো। আলনার কাপড়গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। রুমের এক কোনায় একটি বাইসাইকেল। প্রতিবেদককে দেখে দৌড়ে আসেন হোস্টেলের এমএলএসএস (পিয়ন) মনির ও রশিদ। তারা জানান, ঘটনার পর হলের সব ছাত্র তাড়াহুড়ো করে সটকে পড়ে। তাই এ অবস্থা।

হলের পাশে মেডিকেলের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের কলোনি। ‘সাংবাদিক’ শোনার পর এ কলোনির লোকজন অনেকেই বন্ধ করে দেন ঘরের দরজা। যে দু-একজন কথা বলেছেন, গোপন রেখেছেন পরিচয়। তাদের মধ্যেও অজানা আতংক।

একাধিক ব্যক্তি জানান, ঘটনার দিন হলে ডিউটিতে ছিলেন এমএলএসএস রশিদ। ১০০৩নং কক্ষে যখন তাওহীদকে নির্যাতন করছিল ছাত্রলীগ ক্যাডাররা, রশিদ তখন গেটে তালা দিয়ে পাহারা দিচ্ছিল। তাওহীদের চিৎকার শুনে অনেকেই এগিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু রশীদ তাদের তাড়িয়ে দেন। তারা জানায়, ছাত্রলীগ ক্যাডারদের সব অপকর্মের সহযোগী হচ্ছে এই রশীদ। অথচ পুলিশ প্রহরায় রশীদ ডিউটি করছে, তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। তাদের দাবি, রশীদকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ছাত্রলীগের টর্চার সেলের অনেক লোমহর্ষক ঘটনা উদ্ঘাটন হবে।

টর্চার সেল ১০০৩ : অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ কক্ষটি ছাত্ররাজনীতির নামে দুর্বৃত্তায়নের নীরব এক সাক্ষী। নিয়মিত মদ, গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবাসেবীদের আড্ডা বসত এখানে। এ আসরের খরচ জোগানো, আমোদফুর্তি ও নানা ‘প্রয়োজন’ মেটানোর জন্য মেডিকেল ছাত্রদের এখানেই টর্চার করে চাঁদা আদায় করা হতো। আর তা করা হতো নিয়মিত। পাশাপাশি কক্ষটি ‘রিমান্ড’ সেলও ছিল ছাত্রলীগের। এছাড়া কক্ষটি ব্যবহার হতো লাঠিসোটা, দা, কিরিচ, হকিস্টিক ও আগ্নেয়াস্ত্র রাখার ‘মালখানা’ হিসেবে।

টর্চার সেলে নির্যাতিত যারা : তাওহীদকে খুনের আগে এ কক্ষে আরও অনেক ছাত্রদল নেতাকর্মী ও সাধারণ নিরীহ ছাত্রদের ‘রিমান্ডে’ এনে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। এদের একজন মেডিকেল ছাত্রদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আশিকুর রহমান আশিক। তাকে ধরে নেয়া হয়েছিল সামসুদ্দিন ছাত্রাবাস থেকে। এ নিয়ে ছাত্রলীগ-ছাত্রদল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে সমঝোতায় সমাধান হয়। তার আগে ছাত্রদল কর্মী সাদ্দামকে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। এছাড়া নির্যাতনের শিকার অনেকেই এখন আর ভয়ে এ নিয়ে কোনো কথাও বলতে চান না।

ভুলুণ্ঠিত অতীত : মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ছিলেন বঙ্গবীর এমএজি ওসমানী। এই বীর সন্তানের জন্মস্থান সিলেট। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তার নামেই করা হয়েছিল এ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নামকরণ। সত্তরের দশকে প্রতিষ্ঠিত এ দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সিলেট বিভাগের একমাত্র সরকারি মেডিকেল কলেজ এখন এটি আর হাসপাতালটি সর্ববৃহৎ সরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান। কলেজের ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাসগুলোর অধিকাংশেরই নামকরণও করা হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নামে।

এ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল যোগ্য চিকিৎসক গড়ে তোলা- যাতে তারা মানবসেবায় অবদান রাখতে পারেন। আর মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্তদের নামকরণে ছিল দেশপ্রেমের মহিমা ও ত্যাগের শিক্ষা।

কিন্তু সে অতীত ও শিক্ষা আজ ভুলুণ্ঠিতপ্রায়। দীর্ঘদিন ধরে কলেজ ও হাসপাতাল জিম্মি রাজনীতি আর ছাত্র রাজনীতির কাছে। গুটিকয়েক দুর্বৃত্ত ও ক্যাডার জিম্মি করে রেখেছে এ দুই প্রতিষ্ঠানকে। ক্ষমতার পালাবদলে বদলে যায় এর নিয়ন্ত্রকদের তালিকাও। সেই ধারাবাহিকতায় হাসপাতাল, কলেজ ছাড়াও সব ক’টি ছাত্রাবাস, ছাত্রীনিবাস এখন শাসক দলের ক্যাডারদের দখলে। আবাসিক হলগুলো ছাত্রলীগ ক্যাডারদের রামরাজ্য। হলের মধ্যেই রয়েছে সংগঠনের কার্যালয়। প্রতিটি হলেই রয়েছে অঘোষিত টর্চার সেল।

টর্চার সেলেই খুন! : তাওহীদকে অজ্ঞান অবস্থায় নয়, খুন করার পরই মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জরুরি বিভাগ ও সিসিইউতে চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল মৃত তাওহীদকে। মহানগর বিএনপির সভাপতি এমএ হকসহ ছাত্রদলের অনেকেই এমন দাবি করছেন জোর গলায়। তারা বলছেন, টর্চার সেলে খুনের বিষয়টি আড়াল করতেই হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসার নাটক সাজানো হয়েছে।

টর্চার সেলের নিয়ন্ত্রক : আবুসিনা ছাত্রাবাসের টর্চার সেলের নিয়ন্ত্রক ছিলেন ছাত্রলীগের কয়েক ক্যাডার। এর মধ্যে মোস্তাফিজুর রহমান রাফির নাম রয়েছে শীর্ষে। তিনি আবুসিনা ছাত্রাবাস ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তাওহীদকে খুনের সময় পর্যায়ক্রমে অনেকেই গিয়েছিল সেই সেলে। এর আংশিক বর্ণনা উঠে এসেছে সৌমেন দে’র জবানবন্দিতেও। এ টর্চার সেলের কথা জানত মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। জানত পুলিশও। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপই নেয়া যায়নি। কারণ তারা শাসক দলের ক্যাডার। নগরীর অনেক প্রভাবশালী ক্ষমতাধর ওদের লালন করে।

এজাহারে যাদের নাম : তাওহীদের চাচা আনোয়ার হোসেন বাদী হয়ে কোতোয়ালি মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের ১০ নেতাকর্মীর নাম রয়েছে ঘাতক হিসেবে। তারা হচ্ছেন, মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি সৌমেন দে, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হাই, রাফি, ফাহিম, জুবায়ের, শরীফ, অন্তর, হাফিজ, পাঠান ও আশিষ। কোতোয়ালি মডেল থানার এসআই সিরাজুল ইসলাম মামলাটি তদন্ত করছেন। সৌমেন দে ছাড়া আর কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।

তাওহীদের পরিচয় : তাওহীদ সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চতুর্থ বর্ষের ৪৯তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। তিনি ছিলেন ছাত্রদল মেডিকেল কলেজ শাখার আপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক। বাড়ি শরীয়তপুর জেলার জাজিরা এলাকায়। পিতা শামসুর রহমান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। মা ও বোনকে নিয়ে নগরীর কাজলশাহ এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। বোন নাহার বেগম সিলেট সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী।

বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল : তাওহীদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে খুনের পর বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল। সৌমেনের জবানবন্দিতে বেরিয়ে এসেছে এসব। ছাত্রলীগ ক্যাডারের গডফাদারদের নাম চলে আসায় আদালত ও পুলিশ প্রশাসনে চরম গোপনীয়তার আশ্রয় নেয়া হচ্ছে। দাবি করা হচ্ছে, তদন্তের স্বার্থেই গোপনীয়তা। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সৌমেনের জবানবন্দিতে অনেক রাঘব বোয়ালের নাম উঠে এসেছে- যারা ছাত্ররাজনীতিতে সুযোগ করে দেয়ার নামে এসব অপরাধ, অপকর্মের প্রশ্রয় দিয়ে আসছিল ক্যাডারদের। যাদের দেখলে সালাম ঠুকতে হয় প্রশাসনের।

বুধবার সন্ধ্যায় আবুসিনা ছাত্রাবাসের ১০০৩নং কক্ষে ডেকে নিয়ে তাওহীদুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটায়। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় ওসমানী হাসপাতালে নেয়ার পর তাওহীদ মারা যান। কলেজ কর্তৃপক্ষ একাডেমিক কাউন্সিলের জরুরি সভা করে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে এবং হত্যা মামলার এজাহার নামীয় ১০ ছাত্রকে সাময়িক বহিষ্কার করে।


 

 
শনি
রোব
সোম
মঙ্গল
বুধ
বৃহ
শুক্র