নতুন শিক্ষাক্রমের পাইলটিং

ষষ্ঠ শ্রেণির বই প্রস্তুত ১ম শ্রেণির খবর নেই

বাজেট প্রস্তাব আটকে আছে মন্ত্রণালয়ে
 মুসতাক আহমদ 
১৪ জানুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় জানুয়ারিতে। অথচ ফেব্রুয়ারিতে শুরু হবে নতুন শিক্ষাক্রমের পরীক্ষামূলক (পাইলটিং) কার্যক্রম। প্রস্তুতি শেষ না হওয়ায় মূলত এই পরিবর্তন। কিন্তু এখনো সমন্বিতভাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে এই কাজ হচ্ছে না। এর ফলে যথাসময়ে গোটা কাজ শুরুর ব্যাপারে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এ বছর মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ এবং প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম পাইলটিং হওয়ার কথা। গত ১৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা অনুমোদন দেন। সে অনুযায়ী প্রণীত হবে শিক্ষাক্রম।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্র জানিয়েছে, ষষ্ঠ শ্রেণির কাজ অনেকটাই শেষ হওয়ার পথে। কিন্তু প্রথম শ্রেণির পাঠ্যবই এখন পর্যন্ত লেখাই শুরু হয়নি। এ ছাড়া শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ আনুষঙ্গিক কাজও বাকি আছে। কেবল শিক্ষাক্রম তৈরি করে বসে আছে এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট শাখা।

এসব বিষয় নিশ্চিত করে এনসিটিবির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক মশিউজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ষষ্ঠ শ্রেণিতে এবার নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে তৈরি পাঠ্যবই পাইলটিং করা হবে। ১৩টি বিষয়ের বই তৈরি শেষে তা মুদ্রণে পাঠানোর অপেক্ষায় আছে। এসব বইয়ের ওপর পাঠদানের জন্য শিক্ষক গাইড দরকার। তাও প্রস্তুত হয়েছে। এখন চূড়ান্ত করে মুদ্রণে পাঠানো হবে।

অন্য দিকে প্রথম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সংস্থাটির সদস্য (প্রাথমিক) অধ্যাপক ড. রিয়াজুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে পাইলটিংয়ের সিদ্ধান্ত আছে। আমরা চেষ্টা করছি। তবে প্রয়োজনীয় বাজেট অনুমোদন না হওয়ায় বই লেখা, শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ আনুষঙ্গিক কাজ করা যাচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিক্ষাক্রমের রূপরেখা তৈরির সময় থেকেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছিল। নতুন শিক্ষাক্রমে অভিজ্ঞতাভিত্তিক লেখাপড়াকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এই কাজে নেতৃত্ব দেয় এনসিটিবির মাধ্যমিক উইং। স্বাভাবিকভাবে মাধ্যমিক স্তরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এ উদ্যোগ স্বাগত হয়েছে। কিন্তু প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবইসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম প্রাথমিক শিক্ষা খাত উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি) থেকে সংস্থান হয়। তাছাড়া প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার নিয়ন্ত্রক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেখান থেকে এ নিয়ে প্রয়োজনীয় সহায়তা পাওয়া যায়নি। বরং নীতিনির্ধারণী বিভিন্ন বৈঠকে ভিন্ন অবস্থান প্রকাশের ঘটনাও ঘটেছে। তাই এ ক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দ ও প্রশাসনিক অনুমোদনসংক্রান্ত জটিলতা দেখা দেয়। সূত্র জানায়, গোড়া থেকে এভাবে দুই পথে হাঁটায় নতুন শিক্ষাক্রম বিলম্ব হয়।

নতুন পাঠ্যবই প্রবর্তন বা পাইলটিংয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায় থাকে। এগুলো হচ্ছে-রূপরেখার আলোকে শিক্ষাক্রম তৈরি, বই রচনা এবং সম্পাদনাসহ চূড়ান্তকরণ; শিক্ষক গাইড তৈরি; পাইলটিংয়ে জড়িত সহকারী শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ।

এগুলো নেপথ্যে বিশেষজ্ঞরা সার্বক্ষণিক তদারকি করেন। এর আগে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমের যে পাইলটিং হয়, তাতে গোটা বই একসঙ্গে ক্লাসরুমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর নির্ধারিত পন্থা অনুযায়ী ক্লাসরুম থেকে ট্রাইআউটের ফল এনে বই চূড়ান্ত করা হয়।

এবারে স্বল্প পরিসরে দুটি ক্লাসে পাইলটিং করা হচ্ছে। গোটা বই একসঙ্গে না দিয়ে তিন ধাপে যাবে। একধাপের বইয়ের পাঠ শেষ হওয়ার একমাস আগে পরের ধাপের বই যাবে। ১০০ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ২০০ প্রতিষ্ঠানে এই পাইলটিং পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরে ৬০টি করে প্রতিষ্ঠান বেছে নেওয়া হয়।

এনসিটিবি সূত্র জানায়, মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে বই ও গাইড তৈরি, শিক্ষক-কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কাজ শেষ হয়েছে। পাইলটিং করার জন্য নির্বাচিত ৭-৮টি স্কুল শেষপর্যায়ে পরিবর্তন হয়েছে। এ কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও একাডেমিক সুপারভাইজারের প্রশিক্ষণ বাকি আছে।

আগামী ২০ জানুয়ারি শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতিতে প্রণীত বইয়ের ওপর দ্বিতীয় পর্যালোচনা হওয়ার কথা আছে। এর আগে বই চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে ‘এক্সটারনাল এক্সপার্ট’ (যারা বই তৈরির সঙ্গে জড়িত নেই) কর্মশালা আছে। এরপর প্রস্তাবিত বই এবং শিক্ষক গাইড মুদ্রণে যাবে বলে জানান এনসিটিবির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক মশিউজ্জামান।

অন্য দিকে প্রাথমিক স্তরে এখন পর্যন্ত শিক্ষাক্রম তৈরির কাজটি হয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু কোন ৬০টি স্কুলে পাইলটিং হবে তা এখন পর্যন্ত নির্ধারিত হয়নি। এ ছাড়া বই (কনটেন্ট) তৈরি ও শিক্ষক-কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ হয়নি। এসব কাজের বাজেট প্রস্তাব প্রায় ২০ দিন আগে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এনসিটিবি থেকে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তা এখনো অনুমোদন হয়নি বলে জানিয়েছেন এনসিটিবি সদস্য ড. রিয়াজুল হাসান। সবমিলে প্রথম শ্রেণির শিক্ষাক্রম নিয়ে বড় সংকট তৈরি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করেও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

উল্লেখ্য, মূল্যায়ন এবং শিখন পদ্ধতিতে বড় রকমের পরিবর্তন এনে সরকার শিক্ষাক্রম রূপরেখা তৈরি করে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যক্রম বদলে যাবে। চূড়ান্ত বাস্তবায়নের আগে পরীক্ষামূলকভাবে প্রবর্তনের নিয়ম আছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পাইলটিং শেষে ২০২৩ সালে প্রথম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে নতুন বই যাবে। ওই বছর সপ্তম শ্রেণিতে পাইলটিং হবে।

২০২৪ সালে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন বই যাবে আর অষ্টম শ্রেণিতে পাইলটিং হবে। এই প্রক্রিয়ায় দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রবর্তন করা হবে নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের অধ্যাপক এম তারিক আহসান যুগান্তরকে বলেন, এর আগে কখনোই এভাবে সমন্বিতভাবে জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখা তৈরি হয়নি। উন্নত দেশে উত্তরণ ও স্বপ্নপূরণের পদক্ষেপ এটা। তাই নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষা কার্যক্রম চালু লক্ষ্য ছিল। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক একসঙ্গে কাজ না করায় রূপরেখার লক্ষ্য পূরণ বিঘ্নিত হবে।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন