আইএমএফ’র শর্ত

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি ব্যবহার করতে হবে

 যুগান্তর প্রতিবেদন 
২২ নভেম্বর ২০২২, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহারের শর্ত দিয়েছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ)। এ শর্ত বাস্তবায়ন করতে বাজারে টাকার প্রবাহ আরও কমানো হবে। এ কারণে কমবে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ। গ্রাহকদের জন্য টাকাকে ব্যয়বহুল করতে আমানত ও ঋণের সুদের হার বাড়াতে হবে। নীতিনির্ধারণী সুদের হার বাড়িয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা নেওয়ার ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খরচ ইতোমধ্যে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

আইএমএফ মনে করে, বৈশ্বিক সংকটের কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো মুদ্রানীতি ব্যবহার করছে। এ নীতি ব্যবহার করে ইতোমধ্যে তারা সুফলও পাচ্ছে। বাংলাদেশও এ নীতি ব্যবহার করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ যুক্তি থেকে আইএমএফ বৈশ্বিক মন্দা মোকাবিলায় ৪৫০ কোটি ডলার ঋণের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি ব্যবহার করার শর্ত আরোপ করেছে। ২৬ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর আইএমএফ মিশন বাংলাদেশ সফরের সময় এ শর্ত নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। এর আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ শর্ত বাস্তবায়নে সম্মতও হয়েছে।

সূত্র জানায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। এ ধরনের মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে বাজারে টাকার প্রবাহে লাগাম টেনে চাহিদা কমিয়ে ফেলা। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়, পণ্যের চাহিদা কমে যায়। ফলে মূল্যস্ফীতির হারও কমে যায়। এর আরেকটি অংশ হচ্ছে সুদের হার বাড়িয়ে মুদ্রাকে ব্যয়বহুল করে তোলা। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো এ নীতি গ্রহণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থের প্রবাহ কমাতে সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিনির্ধারণী সুদের হার কয়েক দফা বাড়িয়েছে। তবে এখনো নিয়ন্ত্রণ আসেনি মূল্যস্ফীতির হার।

তবে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোয় মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও বাংলাদেশে এটি সম্ভব নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, এ দেশে মুদ্রানীতির উপকরণগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। মুদ্রানীতির চেয়ে এখানে বাজারের প্রভাব বেশি। মুদ্রানীতি ব্যবহার করলে খুব বেশি সুফল মিলবে না। কারণ সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির চালুর তিন মাসেও ঋণ প্রবাহে নিয়ন্ত্রণ আসেনি। সরকারি ও বেসরকারি দুই খাতেই বেড়েছে।

সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি দুই খাতেই ঋণের প্রবাহ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। গত অক্টোবর পর্যন্ত দুই খাতেই ঋণের প্রবাহ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি খাতে ৩২ দশমিক ৩ শতাংশ এবং বেসরকারি খাতে ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। মুদ্রার সরবরাহ কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। গত অর্থবছরে এসব লক্ষ্যমাত্রা আরও বেশি ছিল।

তবে বৈদেশিক সম্পদ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এটি কমেছে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কমার কারণে। এটি কমিয়ে বাজারে টাকার প্রবাহ কমানোই ছিল মূল লক্ষ্য। চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ দশমিক ৭ শতাংশ এবং আগামী বছরের জুন পর্যন্ত ২ দশমিক ১ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল। বাস্তবে এটি আরও বেশি কমেছে। কিন্তু এটি কমার ফলে এখন মূল্যস্ফীতিতে স্বস্তির চেয়ে অস্বতিই বেশি। কারণ রেমিট্যান্স ও রপ্তানি কমায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ বেড়েছে। এতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান পড়ে যাচ্ছে। ফলে মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়ছে।

এদিকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব খাতে ঋণের সুদের হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বেঁধে দেওয়া আছে। আমানতের সুদের হার সম্পর্কে বলা হয়েছে ১২ মাসের গড় মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম দেওয়া যাবে না। গত অক্টোবরে ১২ মাসের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। পয়েন্ট টু পয়েন্ট (গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় চলতি বছরের অক্টোবরে) ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ১০ এবং আগস্টে ছিল সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার সবচেয়ে বেশি। ব্যাংকগুলো আমানতের বিপরীতে গড় সুদ দিচ্ছে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। যে কোনো হিসাবেই তা মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। ফলে ব্যাংকে টাকা রাখা মানেই ক্ষয় হয়ে যাওয়া। এদিকে ঋণের সুদও মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। গড় ঋণের সুদের হার ৭ শতাংশ।

এ পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতিবিদরা প্রশ্ন তুলেছেন, উন্নত দেশগুলোয় মুদ্রানীতি ব্যবহার করে মূল্যস্ফীতির হার কমানোর সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশ আদৌ কমবে কি না? কেননা এখানে মুদ্রানীতির উপকরণগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। এর প্রধান কারণ তথ্যের মধ্যকার সমন্বয়ে বিশাল ফারাক। যে কারণে একটির সঙ্গে আরেকটি মিলছে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের বিপরীতে টাকার দুই ধরনের বিনিময় হার নির্ধারণ করে। একটি বাজারভিত্তিতে। এটিকে নমিনাল বা সাধারণ বিনিময় হার বলে। এটি এখন আন্তঃব্যাংকে ১০৩ টাকা। বিভিন্ন দেশের মুদ্রার মান, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি তথ্যের ভিত্তিতে নিরূপন করে প্রকৃত বিনিময় হার। প্রকৃত বিনিময় হার এখন ১১২ টাকা। গত মার্চে ছিল ১১৫ টাকা ৫০ পয়সা। এই দুটির মধ্যে পার্থক্য ৫ থেকে ৮ টাকা হওয়ার কথা। বর্তমানে ৯ টাকা। গড় হিসাবে আরও বেশি। আগে এ ব্যবধান ছিল ১৫ থেকে ২২ টাকা। সম্প্রতি ডলারের চাপে টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় বাজারভিত্তিক বিনিময় হার বেড়েছে।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন