নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে কোথায় দাঁড়িয়ে আজকের অর্থনীতি

 ড. আর এম দেবনাথ 
১০ ডিসেম্বর ২০১৯, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশের অর্থনীতি
বাংলাদেশের অর্থনীতি। ছবি: সংগৃহীত

আর কয়েকদিন পরই ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ। আমাদের গৌরবের বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এ মাসেই আমাদের মাতৃভূমি সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়। বাঙালির নতুন যাত্রা শুরু হয়। কত বছর হল? ১৯৭১ সাল থেকে ২০১৯ সাল। ৪৮ বছর, দু’বছর কম অর্ধশতাব্দী। যে কোনো দেশের উন্নতি-অবনতি, ভালো-মন্দ বিচারের জন্য অনেক সময়।

এই নিরিখে যদি বিচার করি তাহলে আমাদের অগ্রগতি অসামান্য। পাকিস্তানিরা বলত, স্বাধীন হলে তোমরা খাবে কী? পাট, চা ও চামড়া এই তিন পণ্য রফতানি করে কি তোমাদের ভাত-কাপড় হবে?

আরও মারাত্মক কথা বলেছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। পাকিস্তানিদের এ দোসর আমাদের স্বাধীনতার পর বলেছিলেন- ‘বাংলাদেশ একটা তলাবিহীন ঝুড়ি’। এই নিয়ে কত হইচই! বহুদিন চলেছে সে হইচই।

আজ কী মনে হয়? আমাদের অর্থনীতি কোথায়? খাবার-দাবারের অবস্থা কী? অর্থনীতির প্রধান প্রধান সূচকের নিরিখে আমাদের অর্থনীতির অবস্থা কী? অর্থনীতির শক্তি বিচার হয় সাধারণত মুদ্রার মূল্যমান দিয়ে, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ দিয়ে। আছে খাদ্যপ্রাপ্তির কথা, দারিদ্র্য বিমোচনের কথা, আমদানি-রফতানির কথা।

বাজেটের আকার কত, উন্নয়ন বাজেটের আকার কত- এসব প্রশ্নও আছে। আরও কতগুলো সামাজিক সূচক আছে, যার ওপর ভিত্তি করে একটা অর্থনীতির শক্তি বিচার করা হয়। এসব নিরিখে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল্যায়ন করলে স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে?

আমার মনে আছে, ১৯৭২ সালের দিকে উন্মুক্ত সীমান্ত দিয়ে ভারতের কলকাতায় গেলে আমাদের ‘বাংলা টাকা’ কেউ সাধারণভাবে নিতে চাইত না। ১৯৭৯-৮০ সালের দিকেও ১০০ টাকা দিলে তারা দিত ৩৫-৪০ ভারতীয় রুপি। ভীষণ লাগত মনে। নিজেদের গরিব মনে হতো।

আজ বাংলাদেশের ১০০ টাকা দিয়ে ভারতীয় ৭২-৭৬ টাকা পাওয়া যায়। কখনও কখনও আরও বেশি। আর পাকিস্তানি রুপির সঙ্গে আমাদের টাকার তুলনা? এ মুহূর্তে ১৪০-১৫০ পাকিস্তানি রুপি দিয়ে তারা এক ডলার ক্রয় করে। আমাদের লাগে মাত্র ৮৫-৮৬ টাকা। বিনিময় মূল্যের নিরিখে আমরা অনেক শক্তিশালী।

স্বাধীনতার পরপর আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডার ছিল শূন্য। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ভাণ্ডার শূন্য করে দিয়ে যায়। মনে আছে, ২৫-৫০ ডলারের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি লাগত। বহুবার ওই ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক/ডেপুটি গভর্নরের কাছে তদবিরে গিয়েছি ডলারের জন্য।

গিয়েছি বিবি দেবনাথের কাছে, যিনি ছিলেন ‘বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় বিভাগের’ প্রধান। আর আজ? ৫-৭ হাজার ডলারের জন্য, লেখাপড়ার খরচ বাবদ ডলারের জন্য, চিকিৎসার খরচ বাবদ ডলারের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে যেতে হয় না। বাণিজ্যিক ব্যাংকে বিনা প্রশ্নে ওই পরিমাণ ডলার দেয়া হয়।

অনেক উদ্যোক্তা বিদেশে ডলারের বিনিয়োগ করছে। লাখ লাখ বাঙালি পর্যটক আজ সারা বিশ্বে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ডলারের কোনো অভাব নেই। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ৩৩ বিলিয়ন (এক বিলিয়ন সমান শত কোটি) ডলারের মতো। পাকিস্তানিদের কত? ১০ বিলিয়ন ডলারের মতো।

তাদের অর্থনীতি সচল রাখার জন্য এ দুই-তিন বছরের মধ্যে অন্তত তিনবার তারা ‘আইএমএফের’ বেইল-আউটের শরণাপন্ন হয়েছে। আমরা বাজেট করার পূর্বে আগে প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিলে ‘এইড কনসোর্টিয়ামে’ যেতাম সাহায্যের জন্য।

এখন আর যেতে হয় না। ‘ডোনাররা’ কী দেবে, আর কী দেবে না এ নিয়ে আর আমরা চিন্তিত নই। হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে আমরা নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু বানাচ্ছি।

স্বাধীনতার পরপর আমাদের খাদ্যাভাব ছিল। ১৯৭০-এর দশকের প্রথমদিকে চালে আমরা ঘাটতি ছিলাম। এখন চালে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। সোয়া চার কোটি টনের মতো চাল দেশে উৎপন্ন হয়। সরবরাহ প্রচুর হওয়ায় কৃষকরা অনেক সময় ধানের দাম পায় না। শাকসবজি উৎপাদনে বিশ্বে আমাদের প্রথমদিকে স্থান।

মৎস্য উৎপাদনে আমরা বিশ্বে তৃতীয়-চতুর্থ স্থানে। ডিম-দুধ-মাংস-ফলমূল উৎপাদনেও আমাদের সাফল্য ঈর্ষণীয়। নতুন নতুন ফলের চাষ হচ্ছে। বহু সবজি সারা বছর চাষ হয়। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হয়েছে একটি, আর তা হল দারিদ্র্য বিমোচন।

যুগান্তরে প্রকাশিত গত বছরের একটা তথ্যে দেখতে পাচ্ছি, স্বাধীনতার সময় আমাদের দারিদ্র্যের হার ছিল ৮৮ শতাংশ। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা নেমে দাঁড়ায় ২১ দশমিক ৮ শতাংশে। এর মধ্যে অতিদরিদ্র ছিল মাত্র ১১ শতাংশ। আজ ভাতের মাড় খাওয়ার জন্য কোনো লোক গ্রামে নেই।

অথচ আমরা ছোটবেলায় দেখেছি ভাত নয়, ভাতের মাড়ের জন্য মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গরিবরা ভিড় করত। এখন আর এ অবস্থা নেই। উত্তরাঞ্চলে ‘মঙ্গা’ ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। সেই ‘মঙ্গা’ আজ তিরোহিত। দুই বেলা ভাত পায় লোকে। শীতকালে মানুষের কাঁথা, কম্বল, চাদর ছিল না শীত নিবারণের জন্য।

সারা বছর গায়ে জামা-কাপড় থাকত না। পায়ে জুতা ছিল কয়জনের? আর আজ এর ঠিক বিপরীত চিত্র। গ্রামে আগে ১০ টাকার নোটও দেখা যেত না; ১০০ টাকা, ৫০০ টাকার নোট তো দূরের কথা। এখন ‘বাংলা টাকা’ নয়, দেশের হাজার হাজার গ্রামে ছেলেমেয়েরা ‘ডলার নোট’ দিয়ে খেলাধুলা করে।

স্বাধীনতার পরপর কয়জন বাঙালি বিদেশে রোজগার করত? আজ কম করে হলেও এক কোটি, সোয়া কোটি বাংলাদেশি বিদেশে কর্মরত। তারা বছরে ১৪-১৫ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠায়। যারা পাঠায় তারা সিংহভাগ ক্ষেত্রে গরিব কৃষকের ছেলে। ১৪-১৫ বিলিয়ন ডলার মানে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা।

এটা সরকারিভাবে আসা টাকার পরিমাণ। বেসরকারিভাবে কত আসে তার কথা কেউ জানে না। এ টাকা গ্রামের বাজারকে উজ্জীবিত করে রেখেছে। গ্রামে গ্রামে এখন ‘ক্যাশ’ আর ‘ক্যাশ’। উত্তরাঞ্চলের লোক বিদেশে গেছে কম।

কিন্তু ‘বঙ্গবন্ধু ব্রিজের’ কল্যাণে রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী ইত্যাদি অঞ্চলের লোক ঢাকায় এখন আসছে। নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে তারা দেশে নিয়মিত ‘ক্যাশ’ পাঠাচ্ছে। গ্রামাঞ্চল ধীরে ধীরে দালান-কোঠা সংবলিত শহরসম হচ্ছে।

কৃষি আগে হাতের কাজ ছিল। গরু-ছাগল ছিল কৃষির প্রাণ। কৃষি শ্রমিকের কোনো অভাব ছিল না। এখন কৃষিকাজ হয় যন্ত্রে। জমি চাষ, বীজ বোনা, আগাছা উপড়ানো, সার-কীটনাশক ছড়ানো, ফসল তোলা, ফসল মাড়াই, ধান শুকানো, ধান চালে পরিণত করা, বস্তায় ভরা ইত্যাদি যাবতীয় কাজ এখন হয় যন্ত্রে।

কৃষি শ্রমিকের অভাব গ্রামে। এখন ফসল তোলার কাজ হয় চুক্তিতে। সবই নগদ টাকার কাজ। গ্রামাঞ্চলে আগে অনেক ফসল, ফলমূল, শাকসবজির কোনো মূল্য ছিল না। ধরতে গেলে বিনামূল্যেই এসব বিনিময় হতো। এখন প্রতিটি জিনিসের আর্থিক মূল্য আছে। গ্রামীণ অর্থনীতি ‘মানিটাইজ’ হয়েছে, অর্থাৎ টাকার মাধ্যমে বিনিময় হচ্ছে- পণ্যের বদলে পণ্য নয়।

স্বাধীনতার পরপর আমাদের ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার কত ছিল? বহুদিন চলেছে ৩-৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। পরে হয়েছে ৪-৫ শতাংশ। ৫ থেকে ৬ শতাংশ। ৬ থেকে ৭-৮ শতাংশ। ধীরে ধীরে আমরা উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছি। এর ফলে আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে।

অবশ্য এর আগে আমাদের রাজস্ব বাজেটের আকার বড় হয়েছে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার বড় হয়েছে। যুগান্তরের এক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে আমাদের জাতীয় বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকায়।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ছিল ওই বছরে মাত্র ৫০১ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকায়। রাজস্ব বাজেটের আকার, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে আমাদের মাথাপিছু আয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১২৯ ডলার।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১৯০৫ ডলার। এ উল্লম্ফনে আমাদের আমদানি-রফতানি ব্যবসার অবদান আছে যথেষ্ট। রফতানির বড় পণ্য হচ্ছে তৈরি পোশাক। এ ধরনের সেলাই কারখানায় ৩০-৩৫ লাখ নারী শ্রমিক ও অন্যান্য শ্রমিক কাজ করে। এদের কাজের স্বীকৃতিও আছে মাথাপিছু আয় বর্ধনে।

দেখা যাচ্ছে, এ আমদানির পরিমাণ ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ছিল মাত্র ২৯ কোটি ডলারের মতো। এখন এর পরিমাণ ৫০-৫৫ বিলিয়ন ডলারের মতো। আর রফতানি? রফতানির পরিমাণ ছিল তখন মাত্র ৩৩ কোটি ডলারের মতো। এখন তা ৩৬ বিলিয়ন ডলারের উপরে।

এসব অগ্রগতির ফলে আজ আমরা বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছি। যে পাকিস্তানিরা বলত ‘তোমরা খাবে কী’, সেই পাকিস্তানি অর্থনীতির তুলনায় আমাদের অর্থনীতি অনেক বেশি মজবুত।

শিক্ষার হার, নারী শিক্ষা, গড় আয়ু, আমদানি-রফতানি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, দারিদ্র্য হ্রাসের হার, মাথাপিছু আয়- প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা আজ পাকিস্তানের চেয়ে অগ্রগামী। এমনকি অনেক সূচকে, বিশেষ করে সামাজিক সূচকে আমরা ভারতের চেয়ে অনেক বেশি ভালো করছি।

আর এসব এখন ভারত ও পাকিস্তানে সাধারণ আলোচনা। কথায় কথায় ওখানে আজ আমাদের সাফল্যের কথা তুলে ধরা হচ্ছে। প্রসঙ্গত বিদ্যুতের কথা বলতেই হয়। আগে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ বলতে কিছু ছিল না।

আর এখন ৯০ শতাংশ গ্রাম বিদ্যুতের আওতায়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৬২৯ মেগাওয়াট। কাগজে দেখি এখন বিদ্যুৎ অনেক সময় অব্যবহৃত থাকে।

বলা বাহুল্য, উন্নতি-অগ্রগতির পাশাপাশি বেশকিছু সমস্যারও জন্ম হয়েছে। এর মধ্যে আয়বৈষম্য অন্যতম। ঋণখেলাপ, সরকারি খরচের গুণগত মানে অবনতি, শিক্ষার মানে অবনতি, যুবকদের বেকারত্ব ইত্যাদি বড় বড় সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

এসব সমস্যা অবশ্য ‘বাজার অর্থনীতির’ সব দেশেই বিদ্যমান। এ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও ওয়াকিবহাল। এখন দায়িত্ব হচ্ছে জরুরি ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের পথ বের করা।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

rmdebnath@yahoo.com

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন