উত্তরণ ঘটেছে যেমন, চ্যালেঞ্জও বেড়েছে তেমন

 ড. মনসুর আলম খান 
১৪ জানুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের জাতিসংঘের সুপারিশ প্রাপ্তি বাংলাদেশের এক অনন্য অর্জন, অত্যন্ত গর্ব ও আনন্দেরও। অবশ্য আনন্দের মাঝেও শঙ্কা আছে, আছে চ্যালেঞ্জ।

বলা হচ্ছে এই উত্তরণের ফলে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে মর্যাদা বাড়লেও নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে বাংলাদেশকে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত ‘Trade impacts of LDC graduation’ নিবন্ধ মোতাবেক উত্তরণের প্রভাবে বাংলাদেশের রপ্তানি কমে যাবে চৌদ্দ শতাংশ।

মহামান্য রাষ্ট্রপতি যথার্থই বলেছেন, ‘সম্প্রতি বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছে। এটি খুশির খবর। কিন্তু এ নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না’। বর্তমান লেখায় উত্তরণের বহুবিদ চ্যালেঞ্জ ও মোকাবিলার কৌশল নিরূপণে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের পাশাপাশি আমরা মোটা দাগে জানতে চাইব এলডিসি গঠনের উদ্দেশ্য এবং উত্তরণের প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে।

স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) তালিকাকরণের ধারণার উন্মেষ ঘটে ১৯৬০-এর দশকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিপর্যস্ত বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রভাবে যেসব দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা একেবারেই নাজুক, জাতিসংঘ পরিবারের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এবং সুবিধাবঞ্চিত সেসব দেশের জন্য বিশেষ আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যে উদ্ভূত হয়েছে এ ধারণা। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৫তম অধিবেশনের আওতাধীন ২৬২৬ এবং ২৭২৪ নম্বর প্লেনারি আলোচনায় এরূপ তালিকা প্রণয়নের বিষয়ে প্রথম সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরে ১৯৭১ সালে সাধারণ পরিষদের ২৬তম অধিবেশনে 2768 (XXVI). Identification of the least developed among the developing countries শীর্ষক সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে প্রণীত হয় বহুল কথিত স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা। ১৮ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখে প্রকাশিত সেই তালিকায় প্রথমবারের মতো আফগানিস্তান, বেনিন, ভুটান, উগান্ডা, সিকিম ইত্যাদি ২৫টি দেশের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

গত পঞ্চাশ বছরে এই তালিকায় সংযোজন-বিয়োজন ঘটেছে। আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটায় ইতোমধ্যেই উত্তরণ ঘটেছে বতসোয়ানা (১৯৯৪), কেপ ভার্দে (২০০৭), মালদ্বীপ (২০১১), সামোয়া (২০১৪), ইকোটোরিয়াল গিনি (২০১৭), ভানুয়াতু (২০২০) এই ছয়টি দেশের। ১৯৭১ সালে অন্তর্ভুক্ত হওয়া সিকিম ১৯৭৫ সালে অঙ্গীভূত হয়েছে ভারতের সঙ্গে। নভেম্বর ২০২১-এর হিসাব মোতাবেক বর্তমানে এলডিসিভুক্ত দেশের সংখ্যা ৪৬টি।

বাংলাদেশ এলডিসির সদস্যপদ লাভ করে ১৯৭৫ সালের ১২ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি সংক্রান্ত সাধারণ পরিষদের ৩৪৮৭ নম্বর সিদ্ধান্ত ছিল এরূপ-‘Taking into account Economic and Social Council resolution 1976 (LIX) of 30 July 1975, decides to include Bangladesh, the Central African Republic, Democratic Yemen and the Gambia in the list of hard-core least developed countries.’ সেই থেকে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের একটি কার্যকর সদস্য, পেয়ে আসছে সব আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, প্রণোদনা প্যাকেজ।

স্বল্পোন্নত দেশ হিসাবে তালিকাবদ্ধকরণ এবং উত্তরণ উভয়ই নির্ভর করে কোনো দেশের দারিদ্র্য, মানবসম্পদ এবং অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রবণতা-এই তিনটি মানদণ্ডের ওপর। জাতিসংঘের অর্থ ও সামাজিক বিভাগ কর্তৃক ২ মার্চ ২০১৮ প্রকাশিত ‘Criteria For Identification of LDCs’ শীর্ষক প্রতিবেদন মোতাবেক বিবেচ্য বছরের আগের তিন বছরের মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় ১০২৫ মার্কিন ডলারের নিচে হলে এলডিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে এবং ১,২৩০ মার্কিন ডলারের ওপরে হলে উত্তরণের জন্য বিবেচিত হবে।

জাতিসংঘের CDP-এর প্রস্তাব মোতাবেক কোনো দেশের মানবসম্পদ সূচকের (Human Assets Index -HAI) মান ৬০-এর নিচে হলে এলডিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে এবং ৬৬-এর উপরে হলে উত্তরণের জন্য বিবেচিত হবে। HAI-এর মান আবার দুই ভাগে বিভক্ত-১. স্বাস্থ্য সূচক (মান-৫০) এবং ২. শিক্ষা সূচক (মান-৫০)। স্বাস্থ্য সূচকের ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুহার, খর্বতার প্রবণতা এবং মাতৃমৃত্যুর হার এই তিনটি নিয়ামক এবং শিক্ষা সূচকের ক্ষেত্রে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির হার, বয়স্ক শিক্ষার হার এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর অনুপাত এই তিনটি নিয়ামকের মান যোগ করে গণনা করা হয়। জাতিসংঘের CDP 2015 সাল থেকে এলডিসি তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচক (Economic and Environmental Vulnerability Index-EVI)-এর মান ৩৬-এর উপরে এবং উত্তরণের জন্য ৩২-এর নিচে হতে হবে মর্মে নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মাঝে অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক (মান-৫০) নিরূপণ করার ক্ষেত্রে জিডিপি’তে কৃষি খাতের অবদান, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের দূরবর্তিতা ও দেশের স্থলবেষ্টিতা, রপ্তানি পণ্যের বহুমাত্রিকতা এবং পণ্য ও পরিষেবা রপ্তানির অনিশ্চয়তা এই চারটি নিয়ামক এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ সূচকে (মান-৫০) উপকূলীয় অঞ্চলে নিবাসী সংখ্যা, শুষ্ক অঞ্চলে লোকের আবাস, কৃষি উৎপাদনে অনিশ্চয়তা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রবণতা এই চারটি নিয়ামক বিবেচনায় নেওয়া হয়।

এলডিসি দেশগুলোর অবস্থা আদতেই ‘গরিবের মাঝে আরও গরিবে’র মতো। বর্তমানের ৪৬টি দেশের মধ্যে ৩৩টির অবস্থানই আফ্রিকা মহাদেশে, ৯টি পড়েছে আমাদের এশিয়াতে, ইউরোপের কোনো দেশ এই তালিকায় নেই। দেশগুলোর জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন। বিশ্ব জিডিপিতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সম্মিলিত অবদান ২ শতাংশেরও কম এবং বিশ্ব বাণিজ্যে ১ শতাংশের কাছাকাছি, যদিও বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১২ ভাগ (৮৮ কোটি) লোকের বাস এসব দেশে। তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত হয়েছে চারটি বিশেষ সম্মেলন-United Nations Conference on the LDCs। ১৯৮১ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত প্রথম সম্মেলন (UNCLDC-I) থেকে গৃহীত হয় প্যারিস ঘোষণাপত্র (Paris Declaration-1981)। ১৯৯০ সালে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় সম্মেলন। ব্রাসেলসে ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে গৃহীত হয় ‘ব্রাসেলস ঘোষণাপত্র’ এবং ‘স্বল্পোন্নত দেশের জন্য দশ বছরমেয়াদি ব্রাসেলস কর্মসূচি’। চতুর্থ সম্মেলনটির ব্যাপ্তি ছিল ব্যাপক ও উচ্চাভিলাষী। ২০১১ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে গৃহীত হয় Istanbul Programme of Action (IPoA)। ওই সম্মেলনে ২০২০ সালের মধ্যে কমপক্ষে অর্ধেক সদস্যদের উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় মানদণ্ড পূরণ করতে সক্ষম করে তোলার একটি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।

ইস্তাম্বুলে গৃহীত এই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যকে ধারণ করেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ঈউচ-এর নিয়ম অনুযায়ী, এলডিসি থেকে বের হতে হলে পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে নির্দিষ্ট মান অর্জন করতে হয়। উত্তরণের জন্য অন্তত দুটি সূচকে যোগ্যতা অর্জন অথবা মাথাপিছু আয় নির্দিষ্ট সীমার দ্বিগুণ থাকতে হবে। এসব সূচক বিবেচনায় গত ২৪ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের A/RES/76/8 নম্বর সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের পাশাপাশি লাওস এবং নেপালের উত্তরণের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। আনন্দের বিষয় হলো, বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যা যে কোনো দুটির স্থলে তিনটি সূচকেই নির্ধারিত মান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত রূপান্তর ও সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশ দ্রুত উন্নয়নের পথে এসেছে। ২০১৮ সালে উত্তরণের জন্য নির্ধারিত ভিত্তি ২০২১ সালে আরও মজবুত হয়েছে। সিডিপি ২০২৪ সালে অনুষ্ঠেয় পরবর্তী ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভায় পুনরায় বাংলাদেশের অবস্থা যাচাই করবে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আর্থ-সামাজিক সব মানদণ্ডে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে চূড়ান্তভাবে বের হয়ে আসবে।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জের মাত্রা ও ব্যাপ্তি নির্ভর করে সদস্য দেশের জনসংখ্যা, জিডিপির আকার, রপ্তানির পরিমাণ এসব আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর। বর্তমানে বিশ্ববাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ৮৩ ভাগ সেবা ও পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা ভোগ করে থাকে, উত্তরণের ফলে নিশ্চিত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বাংলাদেশি পণ্য। মেধাস্বত্বের ওপর ছাড় পাওয়ায় বাংলাদেশের ঔষধ শিল্পে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত অবাধে ব্যবহার করা যাবে গবেষণালব্ধ জ্ঞান, উত্তরণের ফলে হুমকিতে পড়বে ঔষধ শিল্প। বন্ধ হয়ে যেতে পারে প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক অনুদান। কমে যেতে পারে বৈদেশিক শিক্ষাবৃত্তির পরিমাণ। বিনিয়োগ সহায়তা কর্মসূচি, জাতিসংঘ প্রযুক্তি ব্যাংক ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত জাতিসংঘের বিশেষ তহবিল থেকে প্রাপ্ত সহজ শর্তে ঋণ ও অনুদান প্রবাহ বন্ধ হবে। তারপরও এগিয়ে যেতে হবে।

এগিয়ে যাওয়ার পথে শত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাজ করে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। উত্তরণসংক্রান্ত জাতীয় টাস্কফোর্সের গত ১৫ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সভার সিদ্ধান্তের আলোকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ গ্রহণ করেছে Support to Sustainable Graduation Project শীর্ষক প্রকল্প। ডিসেম্বর ২০১৮-জুন ২০২৪ মেয়াদে বাস্তবায়নাধীন ১৩,৪৭৫ লাখ টাকার প্রকল্পে জাপানিজ অনুদান (ডিআরজিএ-সিএফ) ৯,০১০.৪০ লাখ টাকা, বাকিটা বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে পাওয়া যাবে। চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিতকরণ, সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনকে সম্পৃক্তকরণ, টেকসই উত্তরণ কৌশল প্রণয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান, উন্নয়ন সহযোগী ও সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে নেগোসিয়েশন পরিচালনা করার লক্ষ্যে এসব বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে এ প্রকল্প। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক অন্যান্য সংস্থাও কাজ করে যাচ্ছে টেকসই উন্নয়ন কৌশল প্রণয়নে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব আর সাহসী উন্নয়ন কৌশল বাস্তবায়নের ফলে বিগত দিনগুলোতে বাংলাদেশ সাক্ষী হয়েছে দুর্দান্ত সব অর্জনের। সব সমালোচনা, দেশি-বিদেশি অপপ্রচার আর চক্রান্তের বিপরীতে উন্নয়নের মহাসড়কে ‘দাবায়া রাখতে পারবা না’র বাংলাদেশের এ অদম্য অভিযাত্রায় স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের মানদণ্ড অর্জনের জাতিসংঘের স্বীকৃতি বাংলাদেশের উন্নয়ন-অভিযাত্রায় এক অনন্য অর্জন।

ড. মনসুর আলম খান : জেলা প্রশাসক, মেহেরপুর

monsuralamkhan@gmail.com

 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন