নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

গ্রামীণ জীবনে যন্ত্রের প্রভাব

 ড. আর এম দেবনাথ 
১৫ জানুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় এই যে, আমাদের কৃষি ধীরে ধীরে প্রযুক্তিনির্ভর হচ্ছে। এর ফলে কৃষিতে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। উৎপাদন ৫০ বছরে সাড়ে তিনগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। নানা জাতের কৃষিপণ্য উৎপন্ন হচ্ছে। ফলে কৃষিপণ্যের বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে। মানুষ খেয়ে-পরে আছে। উপোসে কেউ মরে না, ভাতের ফ্যানও কেউ খায় না, যদিও দারিদ্র্য কিছুটা রয়েছে। বলা বাহুল্য, এসব সাফল্যের কথা আমি বহুবার লিখেছি। কৃষি অর্থনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরাও এ সম্পর্কে লিখছেন। আমি আজ তাই ওদিকে যাব না। আমার আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু প্রযুক্তি নয়, কৃষি নয় এবং অর্থনীতিও নয়। আমার বিবেচ্য বিষয়, প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে গ্রামীণ সমাজে কি কোনো পরিবর্তন আসছে? এলে কী ধরনের পরিবর্তন? বলাই উচিত, অর্থনীতির ওপর অনেক জরিপ ও গবেষণার কথা শুনি এবং খবরের কাগজে পড়ি। কিন্তু প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে সমাজ কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছে, আমাদের কৃষক ভাইদের জীবনে কোনো পরিবর্তন এসেছে কিনা, মা-খালা-মাসিমাদের জীবনেরই বা অবস্থা কী? প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে গ্রামাঞ্চলের মানুষ কি ধীরে ধীরে অলস হয়ে পড়ছে, কর্মহীন হচ্ছে? কর্মাভাব, বেকারত্ব কি বাড়ছে? নাকি গ্রামীণ সমাজ স্বস্তি পাচ্ছে, অবসর গ্রহণের জন্য সময় পাচ্ছে। সাংস্কৃতিক জীবনেরই বা অবস্থা কী? এসব ব্যাপারে কোনো জরিপ বা গবেষণার কোনো খবর আমরা পাচ্ছি না, অথচ এটা দরকার। দরকার ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য।

আমরা ছোটবেলায় যে গ্রামীণ সমাজ দেখেছি, কৃষকের যে জীবন দেখেছি, তার যে কালাতিপাত দেখেছি-বলাই বাহুল্য, আজ ৫০ বছর পর সেই সমাজ আর নেই। ছোটবেলায় দেখতাম চাষি ভোরবেলা আজানের পর কাঁধে লাঙল ও জোয়াল নিত। দুই হাতে থাকত দুটি গরুকে নিয়ন্ত্রণের জন্য দুটি দড়ি। চাষি তার খেতে/জমিতে যাচ্ছে-হয়তো বাড়ির একদম কাছেই, নতুবা সামান্য একটু দূরে। তার হালচাষ শুরু হলো, জমি তৈরির কাজ শুরু হলো। হয়তো রোদেলা আকাশ, অথবা বৃষ্টিভেজা পরিবেশ। গুনগুন করে গান গাইছে, আর জমি আবাদের কাজ করছে। নাশতা? নাশতার জন্য চাষি আর বাড়ি যেতে পারত না। ছোট ছোট বাচ্চারা, চাষি ছেলেমেয়েরা নাশতা নিয়ে খেতে-জমিতে যেত। কী খাবার? ভাত, আর হয়তো শুঁটকি মাছের ভর্তা, অথবা কাঁচামরিচ আর লবণ। জমির আইলে বসেই খাওয়া। ছেলেমেয়ের তখন স্কুলে যাওয়ার কথা। বাবাকে সাহায্য করতে গিয়ে তা আর হতো না। দুপুর পেরিয়ে বিকাল। হয়তো ১টা, ২টা, ৩টা-কাজ শেষে চাষির বাড়ি ফেরা। লাঙল, জোয়াল ও গরু রাখার ব্যবস্থা করে চাষি যাবে গোসলে/স্নানে। দুপুরের খাবার সন্ধ্যার আগে। অনেকের বাড়িতে কেরোসিনের কুপি বাতিও জ্বলত না। দুপুরের খাবার আর রাতের খাবার এক হয়ে যেত। সকাল সকাল নিদ্রায় যাওয়া, উঠতে হবে ভোরে, আজানের পরপরই নামাজ, নামাজের পর জমিতে যাওয়া। জমি তৈরির পর হাতে হাতে বীজ বপন অথবা চারা রোপণ। পারলে মজুরের সাহায্য নেওয়া। তারপর ফসল একটু মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে নিড়ানির কাজ। নিজ হাতেই সে কাজ করত চাষি। একটু সচ্ছল চাষি হলে ‘মুনি’ বা মজুর নেওয়া হতো। নিড়ানি, কীটনাশক ওষুধ ছিটানো, মাঝে মাঝে জমি দেখভাল করা, যাতে গরু-ছাগলে ফসল না খায়। তারপর ভাগ্য ভালো হলে; রোদে, বৃষ্টিতে, ঝড়ে ফসল নষ্ট না হলে এবার ফসল তুলে বাড়ি আনার পালা। ফসল কাটতে হবে, মাথায় করে তা বাড়িতে আনতে হবে। প্যাঁক-কাদার মধ্যেই। বাড়িতে ফসলের স্তূপ হবে, তারপর চলবে ফসল মাড়াইয়ের কাজ। বাড়ির ছেলেমেয়েরা, মা-বোনেরা এ কাজের সহায়ক শক্তি। ধান উঠলে তা সিদ্ধ করা, রোদে শুকানো, তারপর ঢেঁকিতে তা তুলে চাল করা। এই যে প্রক্রিয়া, এর প্রতিটি স্তরে মা-খালা-মাসিরা জড়িত। পুরুষ চাষিকে সাহায্য করা, ভাত-তরকারি রাঁধা, তা পরিবেশন করা তাদের কাজ। ছেলেমেয়ে সামলানো আরেক দায়িত্ব। শীতকালে আমন উঠলে পিঠাপুলি তৈরি করা, চিঁড়া-মুড়ি তৈরি করা, মোয়া-নাড়ু বানানো-সবই মা-খালা-মাসিদের কাজ। তাদের খাওয়া-নাওয়া সবার শেষে। অবশিষ্ট যা, তা-ই তাদের সেব্য ও খাদ্য। অধিকন্তু রয়েছে গরু-ছাগলের খাদ্যের জোগানের বিষয়। খড়ই ছিল ভরসা অথবা ঘাস। এসব কাটতে হতো, ‘খাদ্য’ বানাতে হতো। বহু বড় কাজ। পরিশ্রমী গরুর খাদ্যের কমতি হলে চলবে না। কৃষকের কাছে গরুর খাবার আগে, নিজের খাবার পরে।

এই যে জীবন, যা সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করলাম, তার মধ্যে চাষি-কৃষকের অবসরের সময় কোথায়? গল্প-গুজব করার সময় কোথায়? কৃষিকাজের পর যেতে হবে বাজারে। কেনাবেচা করতে হবে। সপ্তাহের বাজার। কৃষিপণ্য বিক্রি না হলে ফিরতে হবে খালি হাতে। এই জীবনে অনিশ্চয়তা পদে পদে। ফসল ঠিকভাবে হবে কিনা, ফসল ঘরে তোলা যাবে কিনা, ফসল নষ্ট হয়ে যাবে কিনা, উদ্বৃত্ত ফসলের দাম পাওয়া যাবে কিনা, বিক্রির টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় সওদা করা যাবে কিনা, অসুখ-বিসুখ হবে কিনা-পদে পদে তার জীবনে অনিশ্চয়তা, অভাব, অনটন, ভাগ্যনির্ভরতা। এই জীবন বছরের পর বছরের। স্বস্তি নেই। আরাম-আয়েশের কোনো সুযোগ নেই। নেই কোনো বিনোদন। একটার পর একটা সমস্যা তার। অভাব-অনটনের সংসারে সে নিত্য অদৃষ্টে বিশ্বাসী। বলা বাহুল্য, এই একটা জীবনই আমরা ছোটবেলায় দেখেছি। তখন এতকিছু বুঝতাম না। শুধু দেখতাম। সেটা পূর্ব-পাকিস্তান (১৯৪৭-৭১) আমলের কথা। আর আজ? আজ কি চাষি-কৃষকের জীবন একই আছে? সে কি ওই অনিশ্চয়তার জীবনেই আছে? তার কি আরাম-আয়েশ নেই?

আজকের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সারা দেশ হয়তো নয়, তবে দেশের বড় অংশের কৃষকরা প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। তার সুফল পাচ্ছে। এখন জমি চাষ করা, চারা-বীজ লাগানো, বীজ বপন, খেত নিড়ানি, কীটনাশক ছিটানো, পাকা ধান কাটা, ধান বাড়িতে তোলা, গাছ থেকে বিছিন্ন করা, শুকানো, ধান থেকে চাল করার সব কাজই যন্ত্রে। জমিতে সেচের জল দেওয়া, বিদ্যুৎচালিত মেশিনে পানি সরবরাহ, ফসল পরিবহণ করাসহ যাবতীয় কাজে এখন শ্রমের ব্যবহার নেই বললেই চলে। দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। জমিতে এখন ‘মুনি’ বা মজুর লাগে না। লাগে না গরু, লাঙল, কোদাল ও জোয়াল। শ্রমের দাম বেশ চড়া। ছোট ও মাঝারি কৃষকরা এই মজুরির বোঝা বহন করতে পারে না। বীজের দাম, সেচের পানির দাম, কীটনাশকের দাম, সারের দাম ইত্যাদি বেশ চড়া। তার চেয়ে চড়া হচ্ছে গ্রামীণ শ্রমবাজার, বিশেষ করে ধান লাগানো এবং জমি থেকে ফসল তোলার সময়। মৌসুমি এ চড়া দামের কারণে কৃষকরা যন্ত্রই পছন্দ করে।

কৃষক নয় শুধু, কিষানিদের কাজও কম। ধান শুকানো, গবাদি পশুর খাদ্য তৈরি ও তা খাওয়ানো, গাছ থেকে ধান আলাদা করার মাড়াই কাজ, বাড়িতে খড় রাখার জন্য স্তূপ তৈরি করা, চাষির খাবার তৈরি করা, ঢেঁকির সাহায্যে ধান ভানা ইত্যাদি সব কাজ থেকে কিষানিরা আজ বহুলাংশে মুক্ত। গরু এখন যতটুকু না চাষের জন্য ব্যবহৃত হয়, তার চেয়ে বেশি হয় মাংস ও দুধের জন্য। ঘাসের জমি কম। পশুখাদ্য সব কৃত্রিম, বাজার থেকে কিনতে হয়। এমনকি ধানের বীজ, পাটের বীজ এসবও কৃষকের হাতে নেই। আগে কৃষক তার সবচেয়ে ভালো জমির একটাতে বীজতলা করত, বীজের জন্য ধান লাগাত। এখন তা থেকে মুক্ত তারা। এসব কিনতে হয় বাজার থেকে। গরু এখন ঘরে থাকে। তার গায়ে কম্বল থাকে শীতে। মশার কামড় থেকে গরুকে বাঁচানোর জন্য মশারি ব্যবহার করা হয়। কিষানিদের দূর থেকে খাবার জল বহন করে আনতে হয় না। পুকুর-ডোবার জল, নদীর জলও এখন তাদের পান করতে হয় না। নলকূপ আছে হাতের কাছেই।

এই চিত্র কি সারা বাংলাদেশে? না, তা নয়। তবে দেশের বড় একটা অংশে। এবং প্রযুক্তির ব্যবহার ধীরে ধীরে বাড়ছে। যাদের জমি-জিরেত নেই, তাদের কথা এখানে হচ্ছে না। কথা হচ্ছে নানা পেশাজীবীর। তাঁতি, কামার, কুমার, জেলে, মাঝি, ঘরামি ইত্যাদি শ্রেণির মানুষেরও কায়িক শ্রম এখন কম। অনেকেই হয়তো কর্মচ্যুত। চীনা সামগ্রীতে বাজার সয়লাব। নদী-খাল-বিল নেই। অতএব জেলেদের কাজ নেই, মাঝিরা বেকার। নৌকা যেখানে চলে, তা চলে ইঞ্জিনে। পালের প্রয়োজন নেই, নেই অধিকসংখ্যক মাঝির প্রয়োজন। তাঁতিরা বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। কামারের দোকানেও বিদ্যুৎ আছে। রিকশা গ্রাম থেকে উঠে যাচ্ছে; গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি উঠে যাচ্ছে। সব এখন যন্ত্রচালিত পরিবহণ। যারা ছনের ঘর বানাত, টিনের ঘর বানাত, তাদের কাজ কমছে, কোথাও কোথাও নেই-ই। মানুষ, অবস্থাপন্ন মানুষ বাড়িঘর পাকা করছে। কাঠের বদলে ব্যবহৃত হচ্ছে ইট, বালি, সিমেন্ট, ইস্পাত-লোহা। দাম বেড়েছে ওস্তাগারদের, জোগালিদের। কাঠমিস্ত্রির কাজ কমেছে, বৈচিত্র্য এসেছে। তারাও বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। হাতপাখা ব্যবহারে আর শ্রম দিতে হয় না। কেরোসিনের জন্য বাজারে যেতে হয় না। সর্বত্র যন্ত্রের ব্যবহারে মানুষের পরিশ্রমের কাজ হ্রাস পেয়েছে, বিলুপ্ত হয়েছে, হচ্ছে। যন্ত্র ও বিদ্যুতের ব্যবহার গ্রামাঞ্চলকে আমূল পরিবর্তন করে দিচ্ছে। গত ৫০ বছরের এ পরিবর্তনের ফলে এখন চেনা গ্রাম অচেনা। শহর শহর ভাব। শহরের সুবিধা সব পাওয়া যাচ্ছে। বাজার-সওদার কোনো অসুবিধা নেই। যাতায়াত-পরিবহণের কোনো অসুবিধা নেই। মানুষ অনেক বেশি ‘মোবাইল’। তাদের মধ্যে যোগাযোগ অনেক বেশি। প্রযুক্তি শুধু কৃষিতে ব্যবহার হচ্ছে না, কৃষিসংক্রান্ত সব কাজে, মৎস্য চাষে, গরুর খামারে প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে শহরের সুবিধা যেমন গেছে, তেমনি গেছে শহরের সব বাজে জিনিসও, বদ অভ্যাসও, সর্বোপরি গেছে অনেক খারাপ দিকও। মাদকের বিস্তারও ঘটেছে।

সব শেষে বলা যায়, প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে মানুষের শ্রম-ব্যবহার হ্রাস পেয়েছে। হাতের কাজ এখন মেশিনে হয়। প্রচুর সময় কৃষকের বেঁচেছে, অন্তত বাঁচার কথা। এতে কি তাদের মধ্যে আলস্য জন্ম নিচ্ছে? তাদের মধ্যে কি কর্মহীনতা, বেকারত্ব, কর্মাভাব দেখা দিচ্ছে? মানুষের আরাম-আয়েশ দৃশ্যত বাড়ার কথা। তা কি বেড়েছে? হাতে কাজ করলে যে সময় লাগত, তার ছটাকও এখন লাগে না। এই সময়টুকু সে কীভাবে কাটায়? খবরের কাগজে দেখা যায় দেশের অনেক অঞ্চলে কৃষকরা জমি অনাবাদি রাখছে। সবজি তারা ঢাকা থেকে আমদানি করে খায়। এর কারণ হিসাবে কেউ কেউ বলছেন রেমিট্যান্সের টাকার কথা। রেমিট্যান্সের টাকায় মেশিনের কাজ করানো হচ্ছে। খরচের টাকা রেমিট্যান্সের টাকা থেকে জোগানো হচ্ছে। কৃষি উদ্বৃত্ত ও রেমিট্যান্সের টাকা মিলে একশ্রেণির কৃষকের হাতে বেশ টাকা হয়েছে। তারা এখন চা-কফি খায়, যা আগে খেত না। বাড়িতে নাশতা না করে দোকানে গিয়ে পরোটা-মাংস খায়। সকালে যায়, দুপুরের পর বাড়িতে আসে। জীবন অনেকটা আরাম-আয়েশের। আগের চেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য অনেক বেশি। অনেকের বেশ সঞ্চয় আছে। তারা জমি কেনে, বাড়ি পাকা করে, কিছু কিছু অবকাঠামো তৈরিতে খরচ করে। চিকিৎসায় যায় অনেক টাকা।

মূল প্রশ্ন, সচ্ছল কৃষকরা আলস্য জীবনে, আরাম-আয়েশের জীবনে চলে যাচ্ছে কিনা? আবার কর্মহীনতা, বেকারত্ব, কর্মাভাব দেখা দিচ্ছে কিনা? এ সম্পর্কে আগেই উল্লেখ করেছি, কোনো জরিপ, গবেষণা নেই। তবে দৃশ্যত মনে হচ্ছে, গ্রামাঞ্চল কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, আয় বৃদ্ধি, প্রবাসী আয়ের ফলে অনেক জায়গায় একটি নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম নিচ্ছে। এটা কিন্তু আগে ছিল না। আগে ছিল জমিদার-তালুকদার আর বিপরীতে চাষা-ভূষা। এখন মনে হচ্ছে একটা নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্ম হচ্ছে। এদের কাজের পরিমাণ কমছে প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে, অন্যদিকে উৎপাদন বৃদ্ধি ও রেমিট্যান্সের কারণে আয় বাড়ছে। ফলে অবসর বাড়ছে, আরাম-আয়েশ বাড়ছে। অপরদিকে প্রযুক্তির কারণে বেকার হওয়া, কর্মহীন মানুষ চেষ্টা করছে বিকল্প পেশায় নিয়োজিত হতে। এর মধ্যে আছে শ্রমজীবী মানুষ, কামার, কুমার, তাঁতি, জেলে, মাঝি-মাল্লা ইত্যাদি শ্রেণির লোক। তবে গ্রামীণ অর্থনীতি, কৃষি, পল্লি উন্নয়নে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ প্রয়োজন অনুসারে না বাড়ার ফলে গ্রামীণ সামাজ সব শ্রম ধরে রাখতে পারছে না। যারা উদ্বৃত্ত তারা চলে আসছে শহরে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে। ঢাকা শহর উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে থাকার ফলে এখানে ‘ক্যাশ’ উড়ছে। সব সুযোগ-সুবিধা এখানে। ছয় লাখের শহর এখন দেড় কোটি মানুষের শহর। ঢাকা অতিবৃদ্ধির সমস্যায় পড়েছে। ঢাকা শহর কি এখন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ভরপুর? বলা বড়ই মুশকিল। নতুনভাবে গ্রামে যে সচ্ছল শ্রেণি গড়ে উঠছে, যাদের অবসরের সময় অনেক বেশি, তারা কি গ্রামীণ সংস্কৃতির কাজে আত্মনিয়োগ করছে? গান-বাজনা-নৃত্য, কাওয়ালি-জারি-লালনগীতি ইত্যাদি গান, নাটক-থিয়েটার, খেলাধুলা ইত্যাদির কি প্রসার ঘটছে? দৃশ্যত মনে হচ্ছে, গ্রামাঞ্চলে ধর্মীয় প্রভাব অনেক বাড়ছে, মানুস অধিকতর ধর্মানুরাগী হচ্ছে। তারা কি তাহলে ধর্মীয় দায়িত্ব পালন, গরিবের উপকার করা, দান-দক্ষিণা ইত্যাদি কাজে ব্যাপৃত হচ্ছে? এসব প্রশ্নের উত্তর দরকার। উত্তর দরকার কেন গ্রামীণ মধ্যবিত্ত মাদক ইত্যাদি নেশার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনই কি এর কারণ?

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন