প্রবারণা পূর্ণিমা এবং দানোত্তম শুভ কঠিন চীবরদান

 প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো 
০৯ অক্টোবর ২০২২, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

প্রবারণার পালি শব্দ ‘পবারণা’। থেরবাদী বৌদ্ধ বিশ্বে আশ্বিনী পূর্ণিমাকে ‘প্রবারণা পূর্ণিমা’ বলা হয়। এ প্রবারণা পূর্ণিমা থেরবাদী বৌদ্ধদের কাছে একটি উল্লেখযোগ্য পূর্ণিমা। বৌদ্ধ ইতিহাসে এ পূর্ণিমার তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য অপরিসীম। বিশ্বের অপরাপর থেরবাদী বৌদ্ধদের মতো বাংলাদেশের সমতল ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী মহাসাড়ম্বরে মহামহিমান্বিত এ আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমাকে বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনসম্মত বহুবর্ণিল অনুষ্ঠানমালা সাজিয়ে প্রতিটি বৌদ্ধ মন্দিরে ও প্যাগোডায় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্যদিয়ে উদ্যাপন করে। উল্লেখ্য, করুণাঘন ভগবান বুদ্ধ বিশ্ব পরিবেশ সুসংরক্ষণ ও জনকল্যাণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার তাগিদে আষাঢ়ী পূর্ণিমার পবিত্র তিথিতে তার শিষ্য ও শিষ্যা হিসাবে দীক্ষালব্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী সংঘকে তিন মাস বর্ষাব্রত অধিষ্ঠানপূর্বক নিজ নিজ বৌদ্ধ মন্দির ও প্যাগোডায় অবস্থান করার বিধান প্রজ্ঞাপ্ত করেছিলেন। পৃথিবীর পরিবেশ সংরক্ষণ ছাড়াও মহান বুদ্ধ তার অহিংস ধর্ম দর্শনকে ভিক্ষু সংঘের মাধ্যমে তাবৎ মানবজাতির মধ্যে মৈত্রী ও অহিংসার নির্মল আবহে তুলে ধরতে চেয়েছেন অর্থাৎ মৈত্রী ও অহিংসার বাতাবরণে সমগ্র পৃথিবীতে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় আত্মনিবেদন।

আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে শ্রাবণী পূর্ণিমা হয়ে মধু পূর্ণিমা বা ভাদ্র পূর্ণিমা অতঃপর আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমা হলো বর্ষাব্রত অধিষ্ঠানের ব্যাপ্তিকাল। বুদ্ধের নির্দেশ হলো এ তিনমাস ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী সংঘ নিরবচ্ছিন্নভাবে ধ্যান-ভাবনায় থাকবে এবং এর মাধ্যমে নিজ নিজ চিত্তের উৎকর্ষ বিধান করবে। ভিক্ষু এবং ভিক্ষুণীরা জীবন চলার পথে অসাবধানতাবশত যদি কোনো সামান্যতম দোষত্রুটি করে থাকে তবে তারা পারস্পরিক ‘আপত্তি দেশনা’র মাধ্যমে পরিশুদ্ধ থাকার অঙ্গীকারে অঙ্গীকারাবদ্ধ হবে। তারা ভিক্ষু সীমায় বসে ভিক্ষু প্রাতিমোক্ষ পাঠ বা দেশনা করবে। ভিক্ষু প্রাতিমোক্ষে সন্নিবেশিত ২২৭ ভিক্ষুদের অবশ্য প্রতিপালনীয় শীলগুলোর মাহাত্ম্য পর্যালোচনাপূর্বক এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও প্রয়োজনীয়তা অনুপুঙ্খ বুঝে নেবেন বয়োজ্যেষ্ঠ স্থবির ও মহাস্থবির মহোদয়গণের কাছ থেকে। ভিক্ষুরা বর্ষার তিন মাস বুদ্ধের ধর্ম-দর্শন গবেষণা করবে। প্রত্যেক অমাবশ্যা পূর্ণিমা ও অষ্টমী তিথিগুলোতে সমাগত অষ্টশীল অধিষ্ঠিত উপোস ব্রতধারী পুণ্য প্রত্যাশী ও দুঃখান্ত সাধনে বদ্ধপরিকর উপাসক-উপাসিকাদের উদ্দেশ্য বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনের ওপর আকর্ষণীয় ভাষণের মাধ্যমে সদাসর্বদা তাদেরকে আত্মকল্যাণ, আত্মশুদ্ধিসহ পর কল্যাণব্রতে আত্মনিবেদিত থাকার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করবেন।

বস্তুত প্রতিনিয়ত ধর্মশ্রবণ, সশ্রদ্ধচিত্তে ধর্মকে তথা সত্য ধর্মকে অন্তরের অন্তঃস্থলে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত রাখার মধ্যদিয়ে প্রতিটি নর-নারী ও ভিক্ষু-ভিক্ষুণীর যাপিত জীবনের পরতে পরতে নিয়মনিষ্ঠভাবে সত্য ধর্মকে প্রতিপালনের একটি জীবনচক্র বির্নিমাণের লক্ষেই করুণাঘন তথাগত বুদ্ধের বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান বিধানের একটি অনন্য সাধারণ মাঙ্গলিক প্রয়াস। আমরা জানি, মহান বুদ্ধ তার ধর্ম ‘শ্রবণ, ধারণ ও অনুশীলন’-এ তিনটি অপরিহার্য, অবিচ্ছেদ্য পারস্পরিক সহায়তাকারী গঠন শৈলীর ওপর পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল ও বিন্যস্ত করেছেন। এ পর্যায়ে এখানে প্রবারণা পূর্ণিমার তাৎপর্য ও ‘প্রবারণা’ শব্দটির অন্তর্নিহিত মাহাত্ম্য আলোচনার অবকাশ রাখে। প্রবারণা পূর্ণিমাতে থেরবাদী বৌদ্ধ বিশ্বের ভিক্ষু-ভিক্ষুণী সংঘ বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান সমাপ্ত করেন। অতঃপর এ পূর্ণিমা তিথিতেই করুণাঘন ভগবানবুদ্ধ তাবৎ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী সংঘকে গ্রামে-গঞ্জে, নগর থেকে নগরান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশনা দান করেন। এই মহৎ যাত্রায় পুণ্য প্রত্যাশী এবং জাগতিক দুঃখ থেকে মুক্তির প্রত্যাশায় থাকা নর-নারীর মাঝে বুদ্ধের সত্যাশ্রয়ী, মৈত্রী ও অহিংসার মহামন্ত্রের আলোকে শান্তিপূর্ণ এবং সহাবস্থানের চিরন্তন রূপরেখায় আকীর্ণ ধর্ম-দর্শন প্রচার করার বিধান দেন। ভিক্ষু-ভিক্ষুণী ও গৃহী নির্বিশেষে সবাইকে তা মেনে চলার নির্দেশ দেন।

করুণাঘন বুদ্ধ সারনাথের মৃগদাবে ‘ধর্মচক্র প্রবর্তনের’ পর পঞ্চশিষ্য তার নবাবিষ্কৃত ধর্ম-দর্শন পরিপূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করার মাধ্যমে দুঃখের মূলীভূত কারণ উপলব্ধ হলে যশ ও তার বন্ধুসহ বর্ষান্তে সর্বমোট ৬০ জন ধর্মজ্ঞানে অধিষ্ঠিত ভিক্ষুকে ধর্ম প্রচারে নিয়োজিত করেন। মহান বুদ্ধের নির্দেশনা ছিল-তোমরা দু’জন একদিকে যেও না। তার নির্দেশে ‘বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়, লোকানুকম্পায়’ শব্দসমূহকে বুকে ধারণ করে সমগ্র জীব-জগতের কল্যাণার্থে আদি, মধ্য ও অন্তে কল্যাণযুক্ত ধর্ম প্রচার করার জন্যে ভিক্ষুরা নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিলেন। তারই ধারাবাহিতায় আজকের এ ২৫৬৬ বুদ্ধাব্দের আশ্বিনী বা প্রবারণা পূর্ণিমার পর থেরবাদী বৌদ্ধ বিশ্বের তাবৎ ভিক্ষুসংঘ প্রবারণার মধ্যদিয়ে বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান পরিসমাপ্তির পরপরই ধর্মপ্রচারে বের হওয়ার তাগিদ অনুভব করেন।

বস্তুত বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান পরিসমাপ্তির পরদিন থেকেই প্রতিটি বৌদ্ধ মন্দির ও প্যাগোডায় দানোত্তম কঠিন চীবর দানানুষ্ঠান শুরু হয়। যেসব মন্দির ও প্যাগোডায় ভিক্ষুসংঘ সাফল্যজনকভাবে বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান সমাপ্ত করার পরাকাষ্টা প্রদর্শনের প্রয়াস পাবেন সেসব মন্দির ও প্যাগোডায় পুণ্যার্থী দায়ক-দায়িকাদের দ্বারা ভিক্ষুসংঘের উদ্দেশে দানোত্তম কঠিন চীবর দানানুষ্ঠান আয়োজনের মধ্যদিয়ে সশ্রদ্ধচিত্তে ত্রিচীবর দান অত্যাবশ্যক। দায়ক-দায়িকাদের জন্য এরূপ মহতী দানানুষ্ঠান সুসম্পাদন মহা পুণ্যদ্যোতক। দানোত্তম শুভ কঠিন চীবর দানানুষ্ঠান চলবে আশ্বিনী পূর্ণিমা থেকে কার্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত দীর্ঘ এক মাস। একটি মন্দির ও প্যাগোডায় বছরে একবার মাত্র এ পবিত্র দানানুষ্ঠান সুসম্পন্ন বা আয়োজন করা যায়।

‘প্রবারণ’ শব্দের অর্থ আশার তৃপ্তি, অভিলাষপূরণ, শিক্ষার সমাপ্তি অথবা ধ্যানশিক্ষার পরিসমাপ্তি বোঝায়। এখানে ‘প্রবারণা’ থেকে ‘প্রবারণ’ শব্দটি এসেছে। ‘প্রবারণা’ শব্দের আরও তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ হলো-পরিতোষ, তৃপ্তি, সন্তুষ্টির বিষয়, ক্ষতিপূরণ, প্রায়শ্চিত্ত ও ঋণপরিশোধ। অতএব ‘প্রবারণা’ শব্দটি বারণ করা, নিষেধ করা, পরিত্যাগ করা, সমাপ্ত করা অর্থে সমধিক প্রয়োগসিদ্ধ শব্দ হিসাবেও বিবেচিত এবং পরিগৃহীত।

বৌদ্ধ ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে মহান বুদ্ধ যখন শ্রাবস্তীর জেতবন মহাবিহারে অবস্থান করছিলেন, তখন কোশাল থেকে একদল ভিক্ষু বর্ষাব্রত সমাপনান্তে বুদ্ধের সন্নিধানে উপস্থিত হয়েছিলেন। বুদ্ধ তাদের বলেছিলেন-ভিক্ষুসংঘ একস্থানে সম্মিলিতভাবে বসবাস করলে তাদের মধ্যে বহুবাদবিসংবাদ হওয়া অস্বাভাবিক নহে। বর্ষাবাস সমাপ্তির পর তোমরা অবশ্যই একত্র হয়ে প্রবারণা করবে। পরস্পর পরস্পরের দোষত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে এবং পরস্পরকে সত্যিকারভাবে বরণ করে নেবে। একস্থানে থাকার সময় পরস্পর-পরস্পরকে অনুশাসন বা ক্ষেত্র বিশেষে ‘বারণ’ করলে উভয়ের পরম মঙ্গল সাধিত হয়। শাসন পরিশুদ্ধ হয়। এর ফলে সমগ্র ভিক্ষুসংঘের সার্বিক উন্নতি সাধন হয়। ভিক্ষুসংঘের দ্বারা সাফল্যজনকভাবে ‘প্রবারণা’ উদ্যাপন সুসম্পন্ন হলে তাদের উদ্দেশে পুণ্যার্থী দায়ক-দায়িকাদের দ্বারা দানোত্তম পবিত্র কঠিন চীবর দানানুষ্ঠানের আয়োজন করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। কোন বিহারে তিন মাস বর্ষাবাস উদ্যাপনপূর্বক কোনো ভিক্ষুর প্রবারণার আনুষ্ঠানিকতা সুসম্পন্ন না হলে সে বিহারে কঠিন চীবর দানের আয়োজন অসম্ভব বলে বুদ্ধ বিনয়ে বিধৃত রয়েছে।

লাগামহীন লোভ-লালসার প্রবারণা, পরচর্চা, পরনিন্দা ও পর-ছিদ্রান্বেষণ তাড়িত বদকর্মসংস্কৃতিকে পরিপূর্ণভাবে প্রবারণ। অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত, বর্বরতম ও নৃশংসতম কর্মকাণ্ডগুলো সর্বতোভাবে পরিত্যাগ বা প্রবারণ। ওই স্থলে শুধু মানবই নয় বরং তাবৎ প্রাণী প্রজাতির শান্তিময় সহাবস্থান, চেতনার আবাহন ও উৎসর্জন, বিশ্বব্যাপী অহিংসা ও মৈত্রীর স্পন্দমান ঢেউ মাঙ্গলিক কর্ম-সংস্কৃতির ধারণ, কর্ষণ, লালন ও বাস্তবায়ন। এসবই মূল উদ্দেশ্য হয়ে ২৫৬৬ বুদ্ধাব্দের শুভ আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমার সার্বিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসাবে সৃষ্টির সেরা জীব মানব-মানবীর অন্তকরণে আবাহনের শঙ্খধ্বনি বাজুক, এ আশাবাদ ব্যক্ত করি।

ভেন. প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো : অধ্যক্ষ, আনন্দ বিহার ও শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহার, ঢাকা

 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন