বনায়নের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ

 ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম 
২২ ডিসেম্বর ২০২০, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

দেশে প্রায় ২.৬ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি রয়েছে। মোট ভূমির প্রায় ১৭ দশমিক ৫০ শতাংশ বনাঞ্চল, যদিও পরিবেশ সংরক্ষণে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা উচিত। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, দেশে বিদ্যমান বনাঞ্চলে প্রায় ৭ দশমিক ৫ শতাংশ বনভূমি কম রয়েছে। পাহাড়, ম্যানগ্রোভ ও শালবন রক্ষণাবেক্ষণে বনবিভাগ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।

বনবিভাগের তত্ত্বাবধানে প্রায় ১ দশমিক ৫৩ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি রয়েছে, যা বিদ্যমান বনাঞ্চলের প্রায় ১০ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ১৯৭৩ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, দেশে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে ১৬টি সংরক্ষিত বায়ো ইকোলজিক্যাল জোন রয়েছে, যেখানে প্রায় ২ লাখ ৪১ হাজার ৬৭৫ হেক্টর বনভূমি রয়েছে।

ওই সংরক্ষিত জোনের আওতায় আটটি জাতীয় পার্ক, সাতটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং একটি গেইম রিজার্ভ এরিয়া রয়েছে। বনবিভাগের তত্ত্বাবধান ছাড়াও সামাজিক, পারিবারিক, চা ও রাবার বাগানে প্রায় ১ দশমিক ১৭ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি রয়েছে।

পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, বনবিভাগের তত্ত্বাবধান ছাড়াও দেশে প্রায় অর্ধেক বনাঞ্চল রয়েছে। যদিও বনবিভাগ সংরক্ষিত এলাকায় বনায়নে ও রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে, তবুও বনজসম্পদ হ্রাসে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থায় বনবিভাগ কর্তৃক পরিবেশ সংরক্ষণে বনজসম্পদের রক্ষণাবেক্ষণে আরও গুরুত্বারোপ করতে হবে।

তাছাড়া সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনও বনাঞ্চল বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। বনজসম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে সরকারেরও অবদান রয়েছে। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদকের নেতৃত্বে গঠিত ‘গ্রিন এনভায়রনমেন্ট মুভমেন্ট’ সারা দেশে বিভিন্ন ধরনের বৃক্ষরোপণ করে যাচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে, মুজিববর্ষ উপলক্ষে এক কোটির বেশি বৃক্ষরোপণ করা হবে, যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন মডেলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বর্তমান সরকারের নির্দেশনায় দেশের প্রতিটি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকরি প্রতিষ্ঠানে গাছ লাগানো হচ্ছে। দেশে বিদ্যমান বন গবেষণা প্রতিষ্ঠানও বনজসম্পদ বৃদ্ধিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ও পরিবেশ সংরক্ষণে বনজসম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং সামাজিক বনাঞ্চল বৃদ্ধিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। গবেষকরা পরিবেশ সংরক্ষণে বনজসম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের ওপর গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন।

একদিকে যেমন মানুষের প্রয়োজনে বনাঞ্চলের গুরুত্ব রয়েছে, অন্যদিকে মানুষই প্রয়োজনে বনভূমি ধ্বংস করছে। যদিও বর্ধিত জনসংখ্যার মৌলিক চাহিদার প্রয়োজনে বাসস্থান, আসবাবপত্র, খাদ্য, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি ও কলকারখানা নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তবুও পরিবেশ সংরক্ষণে বন সম্প্রসারণ ও বনজসম্পদ সংরক্ষণের গুরুত্ব অপরিসীম।

বাস্তব পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, অনুমতিবিহীন বৃক্ষ কর্তন ও সংরক্ষিত বনভূমির কৃষি জমিতে স্থানান্তর, পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব, নদী-নালা ভরাট, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মাটি, পানি ও বায়ুদূষণে প্রতিনিয়ত বনভূমি হ্রাস পাচ্ছে।

পরিবেশ সংরক্ষণে বিদ্যমান বাস্তব অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার, রাজনৈতিক দল ও গবেষকদের সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সেদিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে প্রত্যেক ব্যক্তিকে একটি করে ফলদ, বনজ ও ঔষধিসহ কমপক্ষে তিনটি গাছ লাগানের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও অফিস-আদালতের প্রাঙ্গণে বৃক্ষরোপণের আহ্বান জানিয়েছেন।

মানুষের টেকসই জীবনযাপনকে প্রাধান্য দিয়েই প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ সংরক্ষণে কর্মরত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় পরিবেশ পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার এবং প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত করে যাচ্ছেন। তিনি বিশ্বের বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে লবণাক্ততার প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছেন। ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়নেও গাছ লাগানোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

পরিসংখ্যানগত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সামাজিক বনাঞ্চল বৃদ্ধিতে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬০১ জন মানুষ আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। ওই প্রণোদনার আওতায় ৩৫৬ কোটি ৮২ লাখ ৩৪ হাজার ৫২২ টাকা মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মুজিববর্ষ উদযাপনে ১০ মিলিয়ন গাছ লাগানোর লক্ষ্যে সমগ্র দেশে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা বিতরণ করে যাচ্ছেন।

মোটা দাগে বলা যেতে পারে, বৃক্ষ ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। এ কারণে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনে দেশে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা উচিত। এর ফলে বনাঞ্চলই বায়ুমণ্ডলে মানবসৃষ্ট গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ কমিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, গাছের পাতা অণুজীবের উপস্থিতিতে মাটিতে পচে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করছে।

বনায়ন, কার্বন স্টোরেজ, পানি ও বায়ুদূষণ কমানোয়, নিউট্রিয়েন্ট সাইক্লিং ও বন্যপ্রাণীর বাসস্থান প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাছাড়া চিত্তবিনোদন ও ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের উপস্থিতিও দেখা যাচ্ছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় কাঠ, খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি ও অন্যান্য বাইপ্রোডাক্ট বনাঞ্চল থেকে সংগৃহীত হচ্ছে।

জাতিসংঘের এজেন্ডা অনুযায়ী, বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়নের তালিকায় অন্তর্ভুক্তিতে বায়ুমণ্ডলে নির্গত গ্রিন হাউস গ্যাস কমিয়ে পরিবেশ সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব পরিবেশ দিবসে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ‘টাইম ফর ন্যাচারে’র উদাহরণ দিয়ে পরিবেশ সংরক্ষণে বনায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

দ্রষ্টব্য : গত ১৬ ডিসেম্বর যুগান্তরে প্রকাশিত ‘জিএমও খাদ্যে স্বাস্থ্য ঝুঁকি কতটা?’ শীর্ষক আমার লেখাটিতে মুদ্রণপ্রমাদজনিত কারণে একটি ভুল ছাপা হয়েছে। লেখাটির এক জায়গায় ছাপা হয়েছে- বিজ্ঞানীরা অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করায় ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ গোল্ডেন রাইস বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে গোল্ডেন রাইস এখনও বাজারে আসেনি, আসবে।

ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম : সহযোগী অধ্যাপক, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

mohammad.alam@wsu.edu

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন