স্বদেশ ভাবনা

সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব বিবেচনার দাবি রাখে

 আবদুল লতিফ মণ্ডল 
১২ জানুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

পরবর্তী নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশগ্রহণকারী কয়েকটি রাজনৈতিক দল ইসি গঠনে আইন প্রণয়ন এবং সে আইনে একটি সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছেন।

সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনে প্রস্তাবকারী রাজনৈতিক দলগুলো হলো-ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল, খেলাফত আন্দোলন ও গণতন্ত্রী পার্টি। যাদের নিয়ে সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, তারা হলেন-প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, সংসদে বিরোধী দলের নেতা, প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেল। সাংবিধানিক কাউন্সিলের মতামত বা সুপারিশের আলোকে সাংবিধানিক পদে নিয়োগদানের নজির পৃথিবীর একাধিক দেশে রয়েছে। দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পদে নিয়োগদানে সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন কেন প্রয়োজন, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

এখন দেখা যাক সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগদানে সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন প্রয়োজন কেন। এটা ঠিক, রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগদান করা হয়। যেহেতু সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ মোতাবেক কেবল প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতিকে তার অন্যসব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হয়, যেহেতু সাংবিধানিক কোনো পদে নিয়োগদানে এখন পর্যন্ত আইন প্রণীত হয়নি, সেহেতু সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। নিচে বিষয়টি স্পষ্টিকরণের চেষ্টা করা হলো।

প্রথমে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির নিয়োগের বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যাক। এটা ঠিক, প্রধানমন্ত্রী নিয়োগে সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে একক ক্ষমতা দিয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগে বাস্তবে রাষ্ট্রপতির কোনো স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা আছে কি? উত্তর হলো, ‘নেই’।

সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী দল বা জোট যে সংসদ সদস্যকে তাদের নেতা হিসাবে নির্বাচিত করেন, তাকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগদান ছাড়া রাষ্ট্রপতির আর কিছু করণীয় থাকে না। সংবিধান প্রধান বিচারপতি নিয়োগে রাষ্ট্রপতিকে একক ক্ষমতা প্রদান করলেও বাস্তবে তিনি এ ক্ষমতা প্রয়োগ করেন না বা করতে পারেন না।

বাস্তবে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ সংবলিত প্রস্তাবে রাষ্ট্রপতি সম্মতি প্রদান করেন। বিভিন্ন সময় পত্রিকায় প্রকাশিত খবর এবং খালেদা জিয়ার শাসনামলের আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এবং শেখ হাসিনার সরকারের সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু ও ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের বক্তব্য থেকে এর সত্যতা পাওয়া যায়। সুতরাং সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হয়েও প্রধানমন্ত্রীরা দেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন।

সংবিধানে নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও গত পঞ্চাশ বছরে উচ্চ আদালতে (হাইকোর্ট বিভাগ এবং আপিল বিভাগ) সাংবিধানিক পদগুলোতে অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারক পদে নিয়োগদানে কোনো আইন প্রণীত হয়নি। দেশের স্বাধীনতার পাঁচ দশকে তিনটি রাজনৈতিক দল-আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ দুদশকের বেশি সময় দেশ শাসন করেছে এবং দলটি বর্তমানেও রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন। বিএনপি চার মেয়াদে একযুগের বেশি সময় দেশ শাসন করেছে। রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ এবং তার নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় পার্টি সরকার সাকুল্যে নয় বছর দেশ শাসন করেছেন। এ তিনটি দলের কোনোটিই সংবিধানের নির্দেশনার আলোকে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নে উদ্যোগী হয়নি। এ সুযোগে সময়ে সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন দলগুলো তাদের ভাবধারা ও আদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের উচ্চ আদালতে, বিশেষ করে উচ্চ আদালতে বিচারক হিসাবে নিয়োগের প্রবেশদ্বার হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক পদে নিয়োগ প্রদান করেছে এবং এখনো করছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে ১৭ ব্যক্তিকে হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করা হয়। ওই সময় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন (এসসিবিএ) এ নিয়োগের বিরুদ্ধে দলীয়করণের অভিযোগ আনে। বিশেষ করে তাদের মধ্যে দুজন সর্বজনাব রুহুল কুদ্দুস ও মো. খসরুজ্জামানের নিযুক্তির বিরুদ্ধে ঘোর আপত্তি জানায় এসসিবিএ। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম অতিরিক্ত বিচারক হিসাবে নিযুক্তি পাওয়া ১৭ জনের মধ্যে ১৫ জনকে শপথবাক্য পাঠ করালেও ওই দুজনকে শপথবাক্য পাঠ করাতে অস্বীকৃতি জানান। পরবর্তী প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তাদের শপথবাক্য পাঠ করান। উচ্চ আদালতের অন্যান্য স্তরে নিয়োগেও দলীয়করণের অভিযোগ রয়েছে।

সংবিধানে নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত উপর্যুক্ত তিনটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে আইন প্রণয়নে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বিগত পাঁচ দশকে সাবেক সচিব মোহাম্মদ আবু হেনা এবং সাবেক সচিব এমএ সাঈদের নেতৃত্বাধীন ইসি ব্যতীত দলীয় সরকারের অধীনে নিয়োজিত অন্য কোনো ইসি সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচন পরিচালনা করতে পারেনি। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় নির্বাচন এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ (জুন), ২০০১ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত যথাক্রমে সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় নির্বাচন ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে ১৯৭৩, ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯৬ (ফেব্রুয়ারি), ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু ছিল না। ক্ষমতায় থাকা দলীয় সরকারগুলো নিজেদের দলীয় ভাবধারা ও আদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের সিইসি ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার হিসাবে নিয়োগ দেয়। জাতীয় নির্বাচন পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকায় ছিল ক্ষমতায় থাকা সরকারগুলো। এসব নির্বাচনে কোনো দলীয় সরকার পরাজিত হয়নি।

অন্যান্য সাংবিধানিক পদে, যেমন-অ্যাটর্নি জেনারেল, মহাহিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান ও অন্যান্য সদস্য পদে নিয়োগদানেও কোনো আইন প্রণীত হয়নি। সংবিধানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি এসব পদে নিয়োগদান করবেন। এর ভিত্তিতে দলীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রীরা নিজ নিজ দলের ভাবধারায় বিশ্বাসী ব্যক্তিদের এসব পদে নিয়োগদানে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিয়ে আসছেন।

সাংবিধানিক পদগুলোয় নিয়োগদানে স্বচ্ছতা আনয়নে অনেক দেশের সংবিধানে বিশেষ বিধান সন্নিবেশিত করা হয়েছে। ২০০১ সালে ১৭তম সংশোধনীর মাধ্যমে শ্রীলংকার সংবিধানে সাংবিধানিক কাউন্সিল (Constitutional Council) গঠনের বিধান করা হয়। স্পিকারের সভাপতিত্বে গঠিত এ কাউন্সিলের অন্য সদস্যরা হলেন প্রধানমন্ত্রী, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা, রাষ্ট্রপতি মনোনীত একজন ব্যক্তি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার যৌথ সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগকৃত পাঁচজন ব্যক্তি এবং সংসদের অধিকাংশ সদস্য মনোনীত একজন ব্যক্তি। বলা হয়, কেবল এ কাউন্সিলের সুপারিশক্রমেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, ন্যাশনাল পুলিশ কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, ঘুস ও দুর্নীতি অনুসন্ধানে গঠিত স্থায়ী কমিশন, ফাইন্যান্স কমিশন এবং ডিলিমিটেশন কমিশনে চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগ দেবেন।

উপর্যুক্ত কমিশনগুলোর চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে নিয়োগের বাইরে আরও কতিপয় অফিসে কর্মকর্তা নিয়োগ সাংবিধানিক কাউন্সিলের সুপারিশের আওতাভুক্ত করা হয়। তারা হলেন-প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিমকোর্টের অন্যান্য বিচারকগণ, আপিল আদালতের প্রেসিডেন্ট ও অন্যান্য বিচারকগণ, জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সদস্যগণ, অ্যাটর্নি জেনারেল, অডিটর জেনারেল, ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ, পার্লামেন্টারি কমিশনার ফর অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (Ombudsman) এবং সেক্রেটারি জেনারেল অব পার্লামেন্ট। ২০১১ সালে সংবিধানের অষ্টাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সাংবিধানিক কাউন্সিলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পার্লামেন্টারি কাউন্সিল। কাউন্সিলের গঠন কাঠামোতেও পরিবর্তন আসে।

২০১৫ সালে গৃহীত প্রজাতন্ত্রী নেপালের সংবিধানে সাংবিধানিক কাউন্সিলের বিধানের সংযোজন নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত ছয় সদস্যবিশিষ্ট কাউন্সিলের অন্য সদস্যরা হলেন-প্রধান বিচারপতি, স্পিকার, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সভাপতি এবং ডেপুটি স্পিকার। এ কাউন্সিল বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে (constitutional bodies) নিয়োগে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ প্রদান করে।

ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সভাপতি ও সিনেটের সভাপতি মনোনীত প্রতিনিধি (প্রত্যেকের তিনজন করে) এবং পদাধিকার বলে সাবেক প্রেসিডেন্টদের (যারা রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন তাদের বাদ দিয়ে) নিয়ে গঠিত সাংবিধানিক কাউন্সিলের দায়িত্ব হলো-প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ডেপুটি ও সিনেটর নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করা। গণভোট অনুষ্ঠান পর্যবেক্ষণ এবং এর ফলাফল ঘোষণাও কাউন্সিলের দায়িত্ব।

গত পাঁচ দশকে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো দেশের সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগদানে অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছে। এসব পদে নিয়োগদানে দলীয় আনুগত্য প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগদানে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ প্রদানে সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে। সাংবিধানিক পদের বাইরে পুলিশ প্রধান, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনার, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, প্রধান তথ্য কমিশনার ও কমিশনারের পদগুলোতেও সাংবিধানিক কাউন্সিলের সুপারিশক্রমে নিয়োগদানের বিধান করতে হবে। পুরো বিষয়টির জন্য সংবিধানে সংশোধনী আনতে হবে।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন